রোগ সারাতে আস্থা ঝোড়ো সংস্কারে

অর্থনীতিকে যতটা রুগ্ণ দেখাচ্ছে, আসলে তার অসুখ আরও জটিল। তাই সেই অসুখ সারাতে কী ধরনের তেতো দাওয়াই জরুরি, প্রাক বাজেট আর্থিক সমীক্ষায় (ইকনমিক সার্ভে) সেই ছবিই স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরল অরুণ জেটলির অর্থ মন্ত্রক। বুধবার সংসদে পেশ করা ওই সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট যে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অর্থনীতির হাল ফেরাতে সবার আগে ভাঁড়ারের হাল ঠিক করতে চাইছে কেন্দ্র। খাদ্য, সার, জ্বালানি ইত্যাদিতে দেওয়া বিপুল ভর্তুকি অন্তত ধাপে ধাপে কমিয়ে আনতে চাইছে তারা।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৪ ০৪:২২
Share:

অর্থনীতিকে যতটা রুগ্ণ দেখাচ্ছে, আসলে তার অসুখ আরও জটিল। তাই সেই অসুখ সারাতে কী ধরনের তেতো দাওয়াই জরুরি, প্রাক বাজেট আর্থিক সমীক্ষায় (ইকনমিক সার্ভে) সেই ছবিই স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরল অরুণ জেটলির অর্থ মন্ত্রক।

Advertisement

বুধবার সংসদে পেশ করা ওই সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট যে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অর্থনীতির হাল ফেরাতে সবার আগে ভাঁড়ারের হাল ঠিক করতে চাইছে কেন্দ্র। খাদ্য, সার, জ্বালানি ইত্যাদিতে দেওয়া বিপুল ভর্তুকি অন্তত ধাপে ধাপে কমিয়ে আনতে চাইছে তারা। চাইছে ‘সত্যিকারের গরিব’ মানুষের হাতে নগদ ভর্তুকি সরাসরি পৌঁছে দিতে। পরিকল্পনায় রয়েছে কর ব্যবস্থার আমূল সংস্কার। যাতে ব্যয় কমিয়ে ও আয় বাড়িয়ে রাজকোষ ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। গুরুত্ব পাচ্ছে চড়া মূল্যবৃদ্ধিতে যে ভাবে হোক রাশ টানাও। একই সঙ্গে, আক্ষরিক অর্থেই ঝোড়ো আর্থিক সংস্কারের পথে হাঁটতে চান নরেন্দ্র মোদী। শুধু শিল্প ও পরিষেবার চৌহদ্দিতে আটকে না-থেকে সংস্কারের রথ ছোটানোর কথা কৃষি ক্ষেত্রেও। রাজনৈতিক ভাবে যা বরাবরই স্পর্শকাতর।

কেন্দ্র মনে করে, চলতি আর্থিক বছরের শেষে এমনিতেই ৫.৪ থেকে ৫.৯ শতাংশের মধ্যে পৌঁছে যাবে বৃদ্ধির হার। আর সংস্কারের পথে চললে, ২০১৬-’১৭ সালের মধ্যেই তা ফিরে যাবে ৭-৮ শতাংশের কক্ষপথে।

Advertisement

এমনিতে এই সমীক্ষা বাজেটের আগের দিন প্রতি বছরই প্রকাশ করে কেন্দ্র। গত এক বছরে অর্থনীতির হাল কেমন দাঁড়িয়েছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা থাকে সেখানে। তাই সেই অর্থে এই সমীক্ষা আদৌ ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু যে ভাষায় এবং যে রকম স্পষ্ট ভাবে সেখানে এ বার ঘাটতি ছাঁটতে ও সংস্কারের জন্য কঠোর ও সাহসী পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তার বড় একটা নজির আগে নেই। যে কারণে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় সংসদে বাজেট বক্তৃতার সময় প্রয়োজনে কড়া দাওয়াই প্রয়োগে পিছপা হবেন না অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি।

অনেকেই মনে করছেন, এই সমীক্ষায় আর্থিক নীতির অভিমুখ বদলের ইঙ্গিতও একেবারে স্পষ্ট। ইউপিএ-জমানার বণ্টন-কেন্দ্রিক নীতি থেকে বৃদ্ধিকে পাখির চোখ করার মন্ত্রে ফিরতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী। ভোটের আগে তাঁর স্লোগান ছিল কম সরকারি হস্তক্ষেপ কিন্তু দক্ষ প্রশাসন। মঙ্গলবার রেল বাজেটে তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। এ বার এই একই ছবি দেখা যাচ্ছে এ দিন প্রকাশিত সমীক্ষার আয়নাতেও।

কেন্দ্র মনে করছে, বাজার অর্থনীতিতে সরকারের এতখানি ভূমিকা অর্থহীন। সে নাক গলাবে সেখানে, যেখানে বাজারেই কোনও সমস্যা রয়েছে। যেমন, হয়তো কোথাও একচেটিয়া ভাবে পুরো বাজারই দখল করে রেখেছে কোনও বেসরকারি বিক্রেতা। কিংবা সরকারের হাত থাকতে পারে সেই সমস্ত পণ্য বা পরিষেবা সরবরাহে (যেমন প্রতিরক্ষা), শুধু বাজারের ভরসায় যেখানে দাম ঠিক করা অসম্ভব। অর্থাৎ, সংস্কারের পথে হেঁটে বেসরকারি ক্ষেত্রকে আরও অনেকখানি জমি ছেড়ে দিতে সরকার তৈরি। তার বদলে বরং তারা মন দিতে চায় লাল ফিতের ফাঁস কমাতে। যাতে প্রকল্পের ছাড়পত্র পেতে এত সময় না লাগে। জোর দিতে চায় কর ব্যবস্থার আমূল সংস্কারে। যে কারণে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছে প্রত্যক্ষ কর বিধি এবং পণ্য-পরিষেবা কর চালু করতে কেন্দ্র যে মরিয়া, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে সমীক্ষায়।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

ইউপিএ-জমানার শেষ কয়েক বছরে সরকারের গলায় সব থেকে বড় কাঁটা হয়ে বিঁধেছিল লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি। লাগাতার সুদ বাড়িয়েও তাতে সে ভাবে রাশ টানতে পারেনি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। আবার সেই চড়া সুদ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল শিল্পের কাছে। কারণ, ব্যবসা চালাতে কিংবা নতুন লগ্নির জন্য অনেক বেশি সুদে ধার নিতে হচ্ছিল তাদের। এমনকী শেষ দিকে এ নিয়ে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজনের মনোমালিন্যের খবরও চাউর হয়েছিল পুরোদমে। সমীক্ষায় কিন্তু কেন্দ্র মেনে নিয়েছে যে, মূল্যবৃদ্ধি সত্যিই মস্ত সমস্যা। এবং যে ভাবে হোক তাতে লাগাম টানা জরুরি। আর তা করতে গেলে যে সবার আগে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে, তা বিলক্ষণ জানেন জেটলি। হয়তো সেই কারণেই জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে কৃষি ক্ষেত্রের সংস্কারে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে সব্জিমন্ডির দক্ষতা নিয়ে। কেন্দ্রের দাবি, ২০১৪ সালের শেষ থেকেই পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি কমবে। আর খুচরো মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যেই নিম্নমুখী।

অহেতুক ভর্তুকি ছেঁটে জেটলি যে রাজকোষ ঘাটতি কমাতে চান, তা ইতিমধ্যেই অনেক বার বলেছেন তিনি। সমীক্ষাতেও জানানো হয়েছে, এই ঘাটতিতে রাশ টানা হবে। জাতীয় আয়ের ২.১ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখা হবে চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রার লেনদেন ঘাটতিও। বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলি মাত্রাছাড়া হলে, আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলির কাছে রেটিং খোয়াতে পারে ভারত। তাই সেই ঝুঁকি জেটলি কখনওই নেবেন না।

তবে শেষ পর্যন্ত বাজেটে রাজকোষ ঘাটতিকে জাতীয় আয়ের কত শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হবে, তা জানতে আগ্রহী সকলে। গত অর্থবর্ষে চিদম্বরম এই ঘাটতিকে ৪.৫ শতাংশে বেঁধে রেখেছিলেন। অন্তর্বর্তী বাজেটে ঘোষণা করেছিলেন তাকে ৪.১ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্যের কথা। কিন্তু সমীক্ষায় অবশ্য বলা হয়েছে, মূলত পরিকল্পনা খাতে খরচ ছাঁটাই করেই তা করা হয়েছিল। যা হওয়া উচিত নয়। তার উপর ইরাক-সমস্যার কারণে তেলের দাম ইতিমধ্যেই বাড়ছে। পূর্বাভাস রয়েছে কম বৃষ্টিরও। তাই এই সমস্ত কথা মাথায় রেখে জেটলি রাজকোষ ঘাটতিকে ৪.৩-৪.৪ শতাংশে রাখতে পারলেই খুশি হবেন বলে অনেকের ধারণা।

অর্থসচিব অরবিন্দ মায়ারামের দাবি, “অর্থনীতির হাল ফেরাতে কী কী করণীয়, এই সমীক্ষা সেই বার্তাই দিয়েছে।” শিল্পমহল এ বিষয়ে একমত। সমীক্ষায় বাস্তব ছবি ফুটে উঠেছে বলে মনে করছে বণিকসভাগুলিও। এখন দেখার, সবার এই আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা জেটলির বাজেট আদৌ মেটাতে পারে কি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন