‘আরও ভয়ঙ্কর মৃত বুরহান’ — পাকিস্তানের ফাঁদে কি পা দিল ভারত? ছবি: এএফপি।
বুরহান ওয়ানি? ও তো ভারতের এজেন্ট!
এটা ছিল যে কোনও সাধারণ কাশ্মীরির বয়ান।
বুরহান ওয়ানি? ও হল মিডিয়ার তৈরি করা একটা কাগুজে বাঘ।
এটা ছিল কাশ্মীরে কর্তব্যরত নিরাপত্তা কর্মীদের বক্তব্য।
বেশি দিন আগের কথা নয়। গত ৭ জুলাইও বুরহান ওয়ানি সম্পর্কে উপত্যকায় এমনই কথাবার্তা চলত। ৮ জুলাই সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। মুহূর্তে বুরহান সম্পর্কে ধারণা বদলে গিয়েছে কাশ্মীরের। হঠাৎ ভারতীয় এজেন্ট থেকে বিপ্লবীতে উত্তরণ ঘটেছে কাশ্মীরি তরুণের। রাতারাতি মিথ দক্ষিণ কাশ্মীরের সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের বিপথগামী তরুণ। গোটা পরিস্থিতির পিছনে কি কোনও সুপরিকল্পিত নকশা রয়েছে? উপত্যকায় গভীরে চোখ রাখলে কিন্তু অনেক ছবি উঠে আসছে।
ছবি: ফেসবুক।
দু’পক্ষের কাছেই বিপথগামী ছিল বুরহান। সেনাবাহিনীর কাছে তো বটেই। ‘আজাদি’-পন্থীদের কাছেও। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় যে তরুণ কাশ্মীরি প্রজন্ম, তাঁদের মধ্যে বুরহান ছিল বেশ জনপ্রিয়। সুদর্শন তরুণ বুরহান জঙ্গি জীবনের নানা ছবি পোস্ট করত ফেসবুকে। হিজবুলের কুখ্যাত কম্যান্ডারদের সঙ্গে পাহাড়ে-জঙ্গলে দিন কাটছে কেমন, ফেসবুকে নিয়মিত ভেসে উঠত সেই ছবি। মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষিত তরুণদের হিজবুলে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করত সে। ‘চকোলেট বয়’ ভাবমূর্তি। আবার গেরিলা পোশাক। হাতে কালাশনিকভ। কাশ্মীরি তরুণদের একাংশের সামনে জেহাদ আর রোম্যান্টিসিজমকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বুরহান। কিন্তু বড় কোনও জঙ্গি হামলায় বুরহান অংশ নিয়েছেন বা ভয়ঙ্কর কোনও নাশকতা ঘটিয়েছেন, এমন রেকর্ড ছিল না। ফলে সেনাবাহিনীও বুরহান ওয়ানিকে নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায়নি।
পরিস্থিতিটা বদলে গেল পামপুরে সিআরপিএফ কনভয়ে সাম্প্রতিক জঙ্গি হানার পর। কোনও জঙ্গি প্রবণতাকে আর রেয়াত করতে রাজি ছিল না সেনাবাহিনী। যেখানে যেখানে জঙ্গি গতিবিধির খবর মিলেছে, সেখানেই অভিযান চালিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। ৮ জুলাইয়ের অভিযানই তেমনই একটি অভিযান ছিল। সেই অভিযানেই খতম হয় হিজবুল কম্যান্ডার বুরহান। সঙ্গে সঙ্গেই ‘আজাদি’র আন্দোলনে মিথ হয়ে ওঠা ‘শহিদ’দের তালিকায় মকবুল বাট, আফজল গুরুর পাশে বুরহান ওয়ানির নামটা জুড়ে গিয়েছে।
কে ছিলেন মকবুল বাট?
ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা তথা জম্মু-কাশ্মীরের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন। এক দিন নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে চলে যান পাক অধিকৃত কাশ্মীরে। ১৯৬৬ সালে ফিরে আসেন নিয়ন্ত্রণ রেখার এ পাশে। অবধারিত ভাবে গ্রেফতার হন। কিন্তু শ্রীনগরের জেল থেকে পালিয়েও যান। আবার পৌঁছে যান পাক অধিকৃত কাশ্মীরে। এ বার পাকিস্তান গ্রেফতার করে নেয় মকবুলকে। ভারতীয় এজেন্ট মকবুল— ধারণা হয়েছিল পাকিস্তানের। পরে পাক জেল থেকে মকবুলের মুক্তি হয়। তিনি আবার ফিরে আসেন। আবার ধরা পড়েন ভারতীয় বাহিনীর হাতে। উপত্যকায় ধারণা চারিয়ে গিয়েছিল, মকবুল বাট আসলে ‘ডাবল এজেন্ট’। ভারত-পাকিস্তান দু’দেশের হয়েই কাজ করছেন তিনি, দু’দেশের সঙ্গেই বেইমানি করছেন। আজাদি-পন্থী কাশ্মীরিদের ধারণা ছিল, মকবুল বাটকে দিয়ে কাশ্মীরিয়তের কোনও উপকার হবে না। কিন্তু ভারত সরকার মকবুলকে ফাঁসিতে ঝোলাতেই মকবুলকে নিয়ে আবেগের স্রোত বইতে শুরু করে উপত্যকায়। আশির দশকে জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের কট্টরবাদী আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠেন মৃত মকবুল বাট।
একই ঘটনা ঘটেছিল আফজল গুরুর ক্ষেত্রেও।
২০০১ সালে ভারতীয় সংসদে জঙ্গি হামলার পর যখন আফজল গুরু গ্রেফতার হলেন, তখনও উপত্যকায় খুব একটা হেলদোল ছিল না দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপককে নিয়ে। কাশ্মীরের অনেকেই তখন ভাবছিলেন, ভারতের এজেন্ট আফজল। জইশ-ই-মহম্মদকে বিপদে ফেলতেই সংসদে জঙ্গিহানার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু আফজলের ফাঁসি রায় ঘোষিত হতেই উপত্যকা উত্তাল হয়। মকবুল বাটের মতো মিথ হয়ে যান আফজলও।
বুরহান ওয়ানির ক্ষেত্রেও ঘটনা পরম্পরা সেই পথেই।
দক্ষিণ কাশ্মীরের ত্রাল এলাকায় বাড়ি। বাবা সরকারি স্কুলের হেডমাস্টার। মসৃণ জীবন। তবে পরিবার বরাবরই জামাত-এ-ইসলামির মতাদর্শে প্রভাবিত। মেধাবী ছাত্র, ক্রিকেটপ্রেমী, ফ্যাশনদুরস্ত, টেক স্যাভি— সচ্ছল, মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ যেমন হন, ঠিক তেমনই ছিলেন। ২০০৭ সাল থেকে অন্য খাতে বইতে শুরু করল জীবন। অমরনাথ শ্রাইন বোর্ডের জমি নিয়ে যে বিতর্কে জম্মু-কাশ্মীর উত্তাল হল, সেই বিতর্ক কট্টরবাদের দিকে ঠেলে দেয় বুরহানকে। জামাত-এ-ইসলামি আর নয়, সংগঠনের জঙ্গি শাখা হিজবুলেই নাম লেখান তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন: অশান্ত কাশ্মীরে কার্ফুর মধ্যেই দেওয়ানচাঁদকে খাবার পৌঁছলেন জুবেদা
হুরিয়ত কনফারেন্স বা উপত্যকার বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কিন্তু বুরহান ওয়ানিকে তখনও বিশ্বাস করেনি। বুরহানকেও ভারতের এজেন্টই ভেবেছিল তারা। ‘‘যেখানে সেনাবাহিনী জঙ্গি গতিবিধি দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেখানে বুরহান ওয়ানিকে এত ছাড় দেওয়া হচ্ছে কেন? ফেসবুকে সে নিজের ছবি পোস্ট করছে, তরুণ প্রজন্মকে খোলাখুলি জেহাদে ডাকছে, অথচ সেনা তাঁকে খোঁজার চেষ্টাই করছে না। এ রকম হয় নাকি?’’ সাধারণ কাশ্মীরির কাছে ৭ জুলাই পর্যন্তও শোনা যেত এই কথা। উপত্যকতার তরুণদের মধ্যে আইএস-এর প্রভাব বাড়ছে, এমনটা প্রমাণ করতেই বুরহানকে ব্যবহার করছে ভারত, বলছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো। কিন্তু বুরহানের মৃত্যু হতেই নিমেষে বদলে গিয়েছে তাঁর ভাবমূর্তি। উপত্যকা উত্তাল তাঁকে নিয়ে। আবার তৈরি হয়েছে নতুন মিথ।
বুরহানের মৃত্যুর পর প্রার্থনায় হিজবুল প্রধান সৈয়দ সালাউদ্দিন।
সেনার পদস্থ কর্তাদের মধ্যেও রয়েছে বিভ্রান্তি।
একাংশ বলছে, ‘‘আর কত ছাড় দেওয়া যায়? খোলাখুলি জঙ্গি হতে আহ্বান জানাচ্ছিল বুরহান। আমরা সব জেনেও চুপ করে থাকব কত দিন?’’
অন্য একটি অংশ বলছে, ‘‘পাকিস্তানের ফাঁদে পা দিলাম আমরা। বুরহান সেই অর্থে জঙ্গি ছিল না। পাকিস্তান আমাদের ফাঁদে ফেলে বুরহানকে খুন করাল। কাশ্মীরের নতুন প্রজন্মের মধ্যে একটা ভারতবিরোধী ‘আইকন’ তৈরি করতে চাইছিল পাকিস্তান। তারা সফল হয়েছে।’’
এই দ্বিতীয় তত্ত্বটাকে কিন্তু উড়িয়ে দিতে পারছে না ওয়াকিবহাল মহল। কারণ বুরহান ওয়ানি সেনা অভিযানে নিহত হওয়ার পর, গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছিল, বুরহানের মৃত্যুকে ‘বোনাস’ হিসেবে দেখছে সেনা। কোকেরনাগে কয়েকজন জঙ্গি লুকিয়ে রয়েছে বলে খবর পেয়ে এলাকা ঘিরে ফেলেছিল সেনা। কুখ্যাত জঙ্গি সরতাজ আহমেদ শেখ সেখানে রয়েছে বলে খবর ছিল সেনার কাছে। অভিযান শেষে জঙ্গিদের দেহ উদ্ধার করার পর জানা গিয়েছিল, বুরহান ওয়ানি রয়েছে মৃতদের তালিকায়। জম্মু-কাশ্মীরের পুলিশও একই কথা জানিয়েছে।
সত্যিই কি তা হলে কোনও ফাঁদ পাতা হয়েছিল? বুরহান ওয়ানি নিজের অজান্তেই কি ব্যবহৃত হয়ে গেলেন পাকিস্তানের টোপ হিসেবে? প্রশ্ন উঠেছে হিজবুল মুজাহিদিনের প্রধান সৈয়দ সালাউদ্দিনকে নিয়েও। পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের সংগঠনের সদস্য বুরহানকে বলি হতে দিলেন কি তিনিই? প্রশ্নচিহ্নগুলো বড় হয়ে উঠছে।