রাজনীতিতে কালো টাকা রুখতে বড় মুখ করে দাওয়াই দেওয়ালেন নরেন্দ্র মোদী, কিন্তু বিরোধীরা বলছেন— ফাঁকফোকরটি বজায় রাখা হল হিসেব কষেই।
নোট বাতিলের পর থেকেই দাবি ওঠে, রাজনীতিতেও কালো টাকার আনাগোনা বন্ধ হোক। বন্ধ হোক নগদে চাঁদা দেওয়ার রেওয়াজও। প্রধানমন্ত্রীও রাজনৈতিক দলের রসদে স্বচ্ছতার কথা বলেন। আর আজ তাঁরই পরামর্শে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেন— এ বার থেকে আর ২০ হাজার নয়, রাজনৈতিক দলগুলিকে নগদে চাঁদা দেওয়া যাবে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। তার ওপরের অঙ্কের সব চাঁদাই নিতে হবে চেকে কিংবা ডিজিটাল মাধ্যমে। এর পাশাপাশি আইন সংশোধন করে একটি বন্ড বাজারে আনার কথা বলেছেন জেটলি। যে বন্ড এক মাত্র চেকে কিংবা ডিজিটাল মাধ্যমে কিনে খুব কম সময়ে এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলকে চাঁদা হিসেবে দেওয়া যাবে।
লোকসভায় বাজেট পেশের সময় জেটলি এ ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী থেকে গোটা শাসক শিবির টেবিল চাপড়ে স্বাগত জানান। কারণ, আপাত ভাবে রাজনীতিতে কালো টাকা রোখা আর নির্বাচনী সংস্কারের লক্ষ্যে এ’টি একটি বড় পদক্ষেপ। এমনকী বিরোধী শিবিরে সেই সময়ে বসে থাকা রাহুল গাঁধীর মুখ থেকেও বেরিয়ে পড়ে ‘গুড’। পরে তিনি বলেন, রাজনৈতিক তহবিলকে স্বচ্ছ করতে যে কোনও পদক্ষেপকে তাঁরা সমর্থন করবেন। কিন্তু বাজেটের পর বিষয়টি আরও খোলসা হতেই আপাত এই সাহসী পদক্ষেপের পিছনের আসল গলদগুলি তুলে ধরে সরব হচ্ছেন বিরোধীরা। আর তা নিয়ে এখন কংগ্রেস-আপের মতো বিপক্ষ নেতাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে খোদ জেটলিকেও।
কারণ, প্রথমত এই আইন সংশোধনটি এখনই নয়, গোটা বিষয়টি চালু হবে ২০১৮ সালে ১ এপ্রিল। ফলে বর্তমানে চালু পদ্ধতিতেই নগদে টাকা তোলার বিস্তর সময় থাকছে রাজনৈতিক দলগুলির হাতে।
দুই, এখন ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নগদে দিলে তাঁর নাম ধাম প্রকাশ করতে হয় না। ভুয়ো নামেই কোনও এক জন ২০ হাজার টাকা করে একাধিক স্লিপ কেটে লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি টাকা কোনও দলকে চাঁদা দিতে পারেন। এ বারে ২ হাজার টাকা হলে খাটনি বাড়বে, স্লিপের সংখ্যাটি বাড়বে বটে, কিন্তু কালো টাকার আনাগোনা ঘুচবে না। ক’দিন আগেই অসরকারি সংস্থা ‘এডিআর’ জানিয়েছে, বিজেপি-কংগ্রেসের মতো দলের প্রায় ৭০ শতাংশ টাকাই আসে ওই ‘অজ্ঞাত’ সূত্র থেকে। মায়াবতীর দলের তো পুরোটাই অজ্ঞাত। আর বাকি দলও পিছিয়ে নেই এতে।
তিন, সরকার যে বন্ড আনার কথা বলছে, তা ব্যাঙ্কে চেক বা ডিজিটাল লেনদেন করে পাওয়া তো যাবে, কিন্তু কোন দলকে কত দেওয়া হচ্ছে, সে’টি গোপন থাকছে। এক দল জানতে পারবে না, অন্য দলকে কে কত দিচ্ছেন। ফলে সাধারণ মানুষের নাগালেও সেই তথ্য আসবে না। আগে বিভিন্ন ট্রাস্টের মাধ্যমে যে’টি আসত, এখন সে’টি হবে বন্ডের মাধ্যমে। যদিও সরকার তথা শাসক দল ইচ্ছে করলেই সে হিসেব জানতে পারে।
কংগ্রেসের নেতারা মনে করছেন, মুখে বড় পদক্ষেপ দেখানোর কথা বলে প্রধানমন্ত্রী আসলে যে ভাবে বিস্তর ফাঁক এখনও রেখে দিলেন, তার মাধ্যমে পরের লোকসভা নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত রসদ যোগাড় করে ফেলবে বিজেপি। কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, ‘‘বিজেপি কোথা থেকে, কার কার থেকে এত অর্থ পাচ্ছে যে এত বিলাসবহুল সব বৈঠক করে!’’ আম আদমি পার্টির প্রাক্তন নেতা যোগেন্দ্র যাদবের মতে, ‘‘রাজনৈতিক দলে নগদের পরিমাণ কমানোটা অর্থহীন। কারণ, সেই পরিমাণ যতই কমানো হোক, ব্যক্তির সংখ্যা কত হবে, তার কোনও সীমা নেই।’’
কংগ্রেসের নেতা আনন্দ শর্মা বলেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদীর ইমানদারি থাকলে একটি নির্বাচনী তহবিল তৈরি করতে পারতেন। বিজেপি যে ঝা চকচকে সভা, জলসা করে, মোদীর সভায় ভূরি ভূরি টাকা খরচ হয়, এত চার্টার্ড বিমান, হেলিকপ্টার তারা ভোটে ব্যবহার করছে, কোন সাধু-সন্তের ব্যাঙ্ক থেকে এই টাকা আসে?’’
তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনও বলেন, চাঁদার পরিমাণ ২০ হাজার থেকে ২ হাজার করলেই নির্বাচনী সংস্কার হয়ে গেল! তা-ও কারা এই সংস্কারের কথা বলছে? যে বিজেপি অজ্ঞাত সূত্র থেকে কোটি কোটি টাকা তুলেছে, তারা করবে সংস্কার!
এই সমালোচনার মুখে পড়ে জেটলির যুক্তি— আসলে নির্বাচন কমিশনই ক’দিন আগে নগদে চাঁদার পরিমাণটি কমিয়ে ২ হাজার টাকা করতে বলেছিল। সরকার সেই প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে মাত্র। অনেক গরিব লোক ছোট অঙ্কের চাঁদা দিতে চেক ব্যবহার করেন না। ২ হাজার সীমাটি তাঁদের কথা ভেবেই বেঁধেছে নির্বাচন কমিশন।
বন্ড নিয়ে জেটলির যুক্তি, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, এক দলকে চাঁদা দিতে হলে অন্য দলও প্রশ্ন তোলে, কেন তাদের দেওয়া হচ্ছে না? ফলে একটি গোপনীয়তা রাখতেই হতো। বন্ডের মাধ্যমে লেনদেন সাদা টাকায় হবে, গোপনীয়তাও বজায় থাকবে। আর ২ হাজার টাকা করে কত ভুয়ো নামেই বা চাঁদার ব্যবস্থা করবে রাজনৈতিক দলগুলি?
কিন্তু এ যুক্তি ধোপে টিকছে না। নরেন্দ্র মোদী এই পদক্ষেপকে যতই ‘মানুষের আশা ও আকাঙ্ক্ষার পূর্তি’ বলে প্রচার করুন, তাঁর অর্থমন্ত্রী কিন্তু দিনের শেষে কবুল করে নিয়েছেন— গোড়ায় গলদ রয়েই গেল।