স্বাগত। নতুন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র সঙ্গে নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের পূর্ণমন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু। সোমবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ
বাংলার হ্যাটট্রিক! নয়াদিল্লির নির্মাণ ভবনে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রীর মন্ত্রীর চেয়ারে! ছ’বছরে পশ্চিমবঙ্গের তিন নেতা-নেত্রী এই কেদারায় বসলেন একের পর এক। প্রথমে ইউপিএ জমানায় তৃণমূলের সৌগত রায়। তৃণমূল ইউপিএ ছাড়ার পরে কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি। আর আজ বিজেপির বাবুল সুপ্রিয় বড়াল।
একই মন্ত্রকে বাঙালির এই হ্যাটট্রিকেও মূল প্রশ্ন কিন্তু ক’টা গোল বাংলার স্কোরশিটে? কী পেল পশ্চিমবঙ্গ? নগরায়ণের নিরিখে এই ছ’বছরে কতটা এগোল এই রাজ্য। ভবিষ্যতেই বা কতটা এগোবে? বিশেষ করে বিজেপি ও তৃণমূল যেখানে কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে প্রবল প্রতিপক্ষ। এবং এই প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জটিকে টেবিলে রেখেই আজ আনুষ্ঠানিক ভাবে নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী পদের দায়িত্ব নিলেন বাবুল।
বিকেলে নির্মাণ ভবনে গিয়ে প্রথমে মন্ত্রকের পূর্ণমন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডুর সঙ্গে দেখা করেন নতুন প্রতিমন্ত্রী। দৃশ্যতই বড় দাদার মতো করে বেঙ্কাইয়া খুব সংক্ষেপে তাঁকে বুঝিয়ে দেন, মন্ত্রকের দু’টি বিভাগ ও কাজের পরিধির কথা। তার পর সৌজন্য দেখিয়ে বাবুলকে তাঁর দফতরের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে যান বেঙ্কাইয়া।
অভিষেকের সেই মুহূর্তটুকু ক্যামেরায় ধরার সময়টুকু রেহাই। পর ক্ষণেই ধেয়ে এল প্রশ্ন। বাংলার জন্য কী ভাবছেন? অতীত অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতা নিয়েই বা আপনার মত কী? মন্ত্রিসভায় ও রাজনীতিতে নবাগত হলেও প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন বাবুল। তাঁর কোশলী জবাব, “বাংলায় গ্রাম ও শহরের উন্নয়নে বিস্তর ফারাক। কলকাতা ও লাগোয়া শহরতলির বাইরে নগরায়ণ বিশেষ হয়নি। কিন্তু কেন হয়নি, কী কারণে হয়নি সেটা বুঝতেই আজ রাজনীতি পাশে সরিয়ে রেখে সৌগত’দাকে (সৌগত রায়) ফোন করেছিলাম। ওঁর সঙ্গে ফের ১২ তারিখ আলোচনায় বসব।” শুধু সৌগতবাবু নন, বাবুল জানান, রাতে মন্ত্রকের প্রাক্তনী ‘দীপাদি’-কেও ফোন করবেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রীদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এমনিতেই কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকে। তার ওপর সৌগতবাবু কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরেই তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প নগরোন্নয়ন মন্ত্রক থেকে রেল মন্ত্রকে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করুন। দেশে নতুন সব মেট্রো প্রকল্প নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের আওতাতেই রয়েছে এবং প্রকল্পের সুষ্ঠু রূপায়ণ করে লাভজনক ভাবে চলছে। তাই নগরোন্নয়ন থেকে রেলে মেট্রো প্রকল্প হস্তান্তরে চেষ্টা তুঘলকি বলে সমালোচনাও হয়েছিল। কিন্তু নেত্রীর নির্দেশ পালনে এ ব্যাপারে কাঠখড় পোড়াতেই সৌগতবাবুর অনেকটা সময় কেটে যায়। বাবুলকে আজ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সৌগতবাবু। তাঁর কথায়, “বাবুলকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। সুবিধা-অসুবিধা কাজের সুযোগের বিষয়গুলি ওঁকে দিল্লি গিয়ে বোঝাব।”
দীপা দাশমুন্সি নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী হন ইউপিএ সরকারের অন্তিম লগ্নে। তত দিনে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে মন্ত্রকের বরাদ্দ ছাঁটা শুরু করে দিয়েছেন মনমোহন সিংহ। তা ছাড়া, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীপা দাশমুন্সির রাজনৈতিক ‘সখ্যও’ সুবিদিত। সেই প্রতিকূলতার প্রসঙ্গ তুলে দীপাদেবী এ দিন বলেন, “নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে রাজ্যের ভূমিকা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অভিজ্ঞতা হল তৃণমূল সরকার আগাগোড়া অসহযোগিতা করেছে। একে তো নগরায়ণের উদ্যোগের অভাব। তাও সবেতেই রাজনীতি টেনে আনত। বিরোধী-শাসিত পুরসভাগুলি কেন্দ্রের প্রকল্প পাওয়ার জন্য রাজ্যের কাছে আবেদন জানালে সেই প্রস্তাব কেন্দ্রের কাছে পাঠাত না।”
কী বলছেন বাবুল? তাঁর বক্তব্য, “হবে না এই নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে প্রথম দিন থেকেই শুরু করতে চাইছি না। কেন হবে না তা বিচার করে কাজের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছি।” তাঁর কথায়, “বাংলার প্রতিনিধি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি আমার একটু পক্ষপাত থাকবেই। রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মাঝে সেতু হওয়াই হবে আমার কাজ।”
এ কথা বলেও রাজ্যে তৃণমূল সরকারকে প্রথম দিনেই খোঁচা দিতেও ছাড়েননি বাবুল। বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানায় কোনও উন্নয়ন তো হয়নি। পরিবর্তনের পরেও কপাল ফেরেনি রাজ্যের। প্রশাসনিক দিক থেকে অনেক ঘাটতি রয়েছে। তা ছাড়া সড়ক বা সেতু নির্মাণে জমি একটা বড় সমস্যা। তবে আমি মনে করি, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক হল স্বামী-স্ত্রীর মতো। সদিচ্ছা থাকলে সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করা যায়। তাতে পরিবারের কল্যাণ হয়। রাজ্য সরকারের থেকে সেই সমন্বয় প্রত্যাশা করব। আর আমিও একশো শতাংশ দেব।”
মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দেন বাবুল। তবে সেখানে যাওয়া ইস্তক ঠোঁটে লেগেছিল পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ। তাঁর কথায়, “ছোটবেলা থেকে দেখছি বাংলায় আঠারো মাসে বছর। দিনের পর দিন গিরিশ পার্কে মেট্রোর কাজ চলছে। রাস্তা হচ্ছে তো হচ্ছেই। আধখানা হয়ে পড়ে আছে সেতুর কাজ। আবার এ-ও দেখেছি মন্দির-মসজিদের বিবাদে রাস্তার কাজ বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু আমি আদতে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। ডন বস্কো স্কুলে পড়েছি। সেই শিক্ষাই পেয়েছি। তাই চাইবো পুরোহিত আর ইমাম, উভয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসে সৌহার্দ্যের সঙ্গে সমস্যার সমাধান করতে।”
যাত্রার শুরুতে এমন প্রত্যয়টাই স্বাভাবিক। প্রশ্নটা তবু থেকেই গেল। পারবেন কি বাবুল বাংলার নগরায়ণে গতি আনতে? হিসেব হবে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকে বাংলার এই ইনিংসের পর।