এল নিনোর দাপটে হাওয়া বদল

মৌসুমি বাতাস যেন চেন্নাই এক্সপ্রেস

বঙ্গোপসাগরে হাওয়ার অভিমুখ ঘুরে যাওয়ায় বদলে গেল পরিস্থিতিটা। যে বায়ুপ্রবাহের কিছুটা চলে যাওয়ার কথা ছিল শ্রীলঙ্কা বা কেরলের দিকে, হঠাৎ তা ঘুরে গিয়েছে চেন্নাই উপকূলের দিকে। সেখানে তৈরি করেছে ঘূর্ণাবর্ত। প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প ঢুকেছে চেন্নাই ও উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে।

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:১০
Share:

বঙ্গোপসাগরে হাওয়ার অভিমুখ ঘুরে যাওয়ায় বদলে গেল পরিস্থিতিটা।

Advertisement

যে বায়ুপ্রবাহের কিছুটা চলে যাওয়ার কথা ছিল শ্রীলঙ্কা বা কেরলের দিকে, হঠাৎ তা ঘুরে গিয়েছে চেন্নাই উপকূলের দিকে। সেখানে তৈরি করেছে ঘূর্ণাবর্ত। প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প ঢুকেছে চেন্নাই ও উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে। তার জেরেই প্রবল বৃষ্টিতে বানভাসি চেন্নাই, এমনটাই বলছেন আবহবিদদের একাংশ।

বলা হচ্ছে, অক্টোবরের শেষাশেষি গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বর্ষা বিদায় নেওয়ার পরপরই সাধারণত বঙ্গোপসাগরে উল্টে যায় বায়ুর অভিমুখ। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুতে পরিণত হয়। বায়ুর অভিমুখের ভিত্তিতেই এই নামকরণ। বর্ষাকালে ওই মৌসুমি বায়ু কেরল হয়ে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল বরাবর উঠে আসে বলে তার নাম দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু। শীতের মুখে সেই বায়ুই মায়ানমারের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে দক্ষিণ অভিমুখী হয়ে যায়। উত্তর-পূর্ব দিক থেকে সে নেমে আসে বলে তার নাম উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু। এর প্রভাবে দক্ষিণ ভারতে শীতের সময়েও বর্ষণ হয়।

Advertisement

তা হলে এ বার চেন্নাইতে যে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে, সেটা আলাদা কীসে? আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, সাধারণত উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলের কাছে এসে বাঁক নিয়ে বিভিন্ন শাখায় ভেঙে যায়। এ বারে সেটা হয়নি।

মৌসম ভবন জানাচ্ছে, অক্টোবরের শেষাশেষি মায়ানমারে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর যাত্রাপথে হঠাৎ বাধা এল। ফলে বাঁকের মুখে আর ভাঙল না বায়ুপ্রবাহ। তার পুরো অভিমুখটাই ঘুরে গেল তামিলনাড়ু উপকূলের দিকে। আর তাতেই দক্ষিণ ভারতে শীতের বর্ষার চরিত্রটা গেল বদলে। বদলে যাওয়া পথে এগোনোর সময়ে ওই বায়ুপ্রবাহ চেন্নাই উপকূল দিয়ে ঢুকিয়ে দিল রাশি রাশি মেঘ। সেই মেঘ থেকে শুরু হল বৃষ্টি। তা আর থামতেই চায় না। নিট ফল, বুধবারের চেন্নাই পেল ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি।

কিন্তু শীতের মৌসুমি বায়ু এ ভাবে গতিপথ বদল করল কেন?

কেন্দ্রীয় আবহবিজ্ঞান মন্ত্রকের অধীনে পুণের আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্রের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ডি শিবশঙ্কর পাই জানান, ‘‘এ বার এমনই কিছু হতে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারছিলাম। কারণ এটা ‘এল নিনো’-র বছর। অঘটন ঘটার বছর।’’ এ বার বর্ষা স্বাভাবিক ছন্দে শুরু হলেও প্রশান্ত মহাসাগরে তৈরি হওয়া ওই ‘দামাল ছেলে’র (এল নিনো) জন্য শেষটা ভাল হয়নি। খরা ঘোষণা করতে হয়েছে কয়েকটি এলাকায়। উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর ক্ষেত্রে দেখা গেল এল নিনো মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের অভিমুখটাকে প্রভাবিত করেছে। বায়ুপ্রবাহকে ঘুরিয়ে দিয়েছে তামিলনাড়ু উপকূলের দিকে আর সেখানেই রয়ে গিয়েছে বায়ুপ্রবাহটি। শিবশঙ্কর বলেন, ‘‘উপকূলের কাছে থাকায় বায়ুপ্রবাহটি শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নিতে পারছে না। কিন্তু যা করছে তা মারাত্মক। চেন্নাইয়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। আরও বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।’’

এল নিনো নামক ভিলেনের জন্যই যে এ বার চেন্নাইয়ের এমন অবস্থা, তা মানছেন পুণের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া পূর্বাভাস দফতরের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল অর্ধেন্দুভূষণ মজুমদারও। তাঁর মন্তব্য, ‘‘উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর গতিপ্রকৃতিকে এল নিনো নিয়ন্ত্রণ করে। সে শক্তিশালী হলে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুতে বৃষ্টি বেশি হবে। চেন্নাইয়ের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।’’


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

বিরুদ্ধ মতও অবশ্য আছে। মৌসুমি বায়ুর চরিত্র পরিবর্তনের জন্য এল নিনোর উপরে দায় চাপাতে রাজিও নন কেউ কেউ। তাঁদের দাবি, উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর সঙ্গে এল নিনোর প্রত্যক্ষ সম্পর্কের বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। বরং দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সঙ্গে এল নিনোর সম্পর্কটা অনেক বেশি পরিষ্কার। ওই প্রাকৃতিক অবস্থার জন্যপূর্ব ও দক্ষিণ উপকূলের তুলনায় পশ্চিম উপকূলে নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় বেশি হয়। ফলে মধ্য, পূর্ব, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ ভারতে বৃষ্টি কম হয়। এ বার বর্ষার শেষ দিকটায় যা হয়েছে। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিজ্ঞান মন্ত্রকের পূর্বাঞ্চলীয় ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথ মনে করেন, ‘‘আরও কী কী কারণ থাকতে পারে খুঁজে দেখতে হবে। শুধু এল নিনো-র উপরে দায় চাপালেই হবে না।’’ চেন্নাইয়ের আঞ্চলিক আবহবিজ্ঞান কেন্দ্রের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল মনে করাচ্ছেন, ‘‘১৯৬১ থেকে ২০১৫-র মধ্যে এমন কিছু বছর রয়েছে, যেখানে ‘এল নিনো’ অতি সক্রিয় না থাকা সত্ত্বেও চেন্নাইয়ে নভেম্বর-ডিসেম্বরে বৃষ্টি হয়েছে।’’

চেন্নাইয়ের এই পরিস্থিতির প্রভাব কি কলকাতায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে? গোকুলবাবু বলেন, ‘‘চেন্নাইয়ের পরিস্থিতির কিছুটা প্রভাব কলকাতায় যে পড়েছে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। আকাশ মেঘে ঢেকে আছে। সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। আর্দ্রতা বেড়ে অস্বস্তিকর অবস্থা। চেন্নাইয়ের মেঘ পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে ঢুকে পড়াতেই এই অবস্থা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। দু’টি পৃথক প্রাকৃতিক অবস্থার জন্য আটকে আছে শীত।’’ তবে চেন্নাইয়ের মেঘ চেন্নাইয়ের মতো পরিস্থিতি অন্তত কলকাতায় সৃষ্টি করবে না, সে বিষয়ে আশ্বস্ত করছেন গোকুলবাবু। তাঁর পূর্বাভাস, আজ বৃহস্পতিবার কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে হাল্কা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তার কারণ, উত্তর ভারত থেকে আসা পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। চেন্নাইয়ের মেঘ শুক্রবারের পর থেকে কেটে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এর পরে কি শীত আসবে কলকাতায়? আলিপুর হাওয়া অফিস জানাচ্ছে, শনিবার সকাল থেকেই কলকাতা থেকে গোটা দক্ষিণবঙ্গের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কমতে শুরু করবে। উত্তুরে হাওয়ার পথ খুলে গিয়ে শীতের পরিস্থিতি তৈরি হবে। ডিসেম্বরের প্রথম রবিবারেই রোদে পিঠ রেখে শীত অনুভব করতে পারবে বাঙালি।

তবে চেন্নাইয়ের দুর্ভোগ কমছে না। বুধবার বিকেলে আলিপুর আবহাওয়া কেন্দ্রের উপগ্রহচিত্র খুলে গোকুলবাবু যা দেখালেন, তাতে কলকাতাবাসীর মুখে হাসি ফুটলেও, চেন্নাইয়ের দুঃখ কাটছে না। ঘন মেঘ ছেয়ে রয়েছে তামিলনাড়ু উপকূল। মেঘের ঘনত্ব সব থেকে বেশি চেন্নাইয়ের উপরেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন