তালিকাটা সরকারের হাতে এসেছিল ইউপিএ জমানাতেই। বিদেশের ব্যাঙ্কে কালো টাকা গচ্ছিত রেখেছেন, এমন ৬২৭ জনের সেই তালিকাই আজ মুখবন্ধ খামে সুপ্রিম কোর্টে পেশ করে দিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। এ বার কী হবে কংগ্রেসের আক্রমণের ধারা! কালো টাকা উদ্ধারের প্রশ্নে সরকার-বিরোধী সমালোচনাই বা আর কদ্দিন জিইয়ে রাখতে পারবে কংগ্রেস! দলের নেতাদের আফশোস, তালিকা হাতে পেয়েও প্রশাসনিক কৌশলের সাবেকি পথে হেঁটে মনমোহন সিংহের সরকার বড় ভুলই করেছিল। যার জেরে ক্ষমতায় থাকতেই কালো টাকার প্রশ্নে যথেষ্ট কোণঠাসা হতে হয়েছে কংগ্রেসকে। আর এখন বিরোধী হিসেবে রাজনৈতিক আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার হাতিয়ারটাও হাতছাড়া হয়ে গেল কংগ্রেসের।
গত কালও সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, অবিলম্বে ওই নামের তালিকা পেশ করতে হবে আদালতে। সরকারকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে সর্বোচ্চ আদালত এ-ও বলেছিল, বিদেশের ব্যাঙ্কে যাঁদের কালো টাকা রয়েছে, তাঁদের মাথায় কেন ছাতা ধরা হচ্ছে! স্বাভাবিক ভাবেই আদালতের পর্যবেক্ষণে আহ্লাদিত ছিল কংগ্রেস।
কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পর কংগ্রেসের নেতারাই বুঝতে পারছেন, আপাতত বেকুব বনে গেলেন তাঁরা। বরং সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে সাময়িক অস্বস্তিতে পড়লেও, দীর্ঘমেয়াদে সুবিধেই হয়ে গেল অরুণ জেটলিদের। বিদেশের ব্যাঙ্কে যাঁরা কালো টাকা গচ্ছিত রেখেছেন তাঁদের নাম প্রকাশের কোনও দায় আর সরকারের রইল না। সেই দায় এখন আদালতের। তা ছাড়া ওই নামের তালিকা ধরে ধরে তদন্তের দায়ও আর সরকারের থাকছে না। কারণ, এ ব্যাপারে গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)-ই এ নিয়ে তদন্ত করছে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে। দশ জনপথের ঘনিষ্ঠ কংগ্রেসের এক শীর্ষ সারির নেতা আজ কবুল করেন, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশই কালো টাকা উদ্ধারে কংগ্রেসের আক্রমণ কিছুটা ভোঁতা করে দিল। সরকার যতক্ষণ ওই তালিকা পেশ বা প্রকাশ না করছিল, তত ক্ষণই আক্রমণ শানিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। এখন সুপ্রিম কোর্ট বা সিট ওই তালিকা প্রকাশ না করলে রাজনৈতিক ভাবে কংগ্রেসের কিছু বলার সুযোগ নেই।
ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির অন্য এক সদস্য বলেন, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে রাজনীতির খেলাটা কংগ্রেসের চেয়ে ভালই খেলল বিজেপি। ইউপিএ জমানায় রামদেব, অণ্ণা হজারেদের পাশে নিয়ে মনমোহন সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করতে আগেই সফল হন বিজেপি নেতৃত্ব। কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী হয়ে অরুণ জেটলি জানিয়ে দেন, তালিকা প্রকাশ হলে কংগ্রেসই অস্বস্তিতে পড়বে। তার পর কংগ্রেসের ৪ জনের নামও সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করে দেওয়া হয় সুকৌশলে। আজ আদালতে ৬২৭ জনের নামের তালিকা পেশ করে হাতই ঝেড়ে ফেলল সরকার।
ক্ষমতায় আসার পরই গত ২৭ জুন মোদী সরকার কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে তদন্তের জন্য সিট গড়েছিল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ভিত্তিতে। প্রাক্তন বিচারপতি এম বি শাহকে কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। মজার বিষয়, সুপ্রিম কোর্টে তালিকা পেশ হওয়ার পর সিটের চেয়ারম্যান বলেন, “নতুন কোনও তথ্য নেই তালিকায়। ওই তালিকা সিটের কাছে আগে থেকেই রয়েছে।” সিট চেয়ারম্যানের মন্তব্যেও বিষয়টা কিছুটা লঘু হল বলে মনে করছেন কংগ্রেস নেতারা।
যদিও কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র অজয় মাকেন আজ বলেন, “কালো টাকা উদ্ধারের প্রশ্নে সরকার-বিরোধী সমালোচনা অব্যাহত থাকবে। লোকসভা ভোটের প্রচারে নরেন্দ্র মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সরকার গঠনের একশো দিনের মধ্যে বিদেশের ব্যাঙ্কে থাকা লক্ষ কোটি টাকা উদ্ধার করবেন। তাতে দেশের প্রতিটি মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে চলে আসবে। গত পাঁচ মাসে পাঁচ পয়সাও উদ্ধার হয়নি। দেখা যাক পাঁচ বছরে ক’টাকা উদ্ধার করে সরকার।” কংগ্রেসের অন্য মুখপাত্ররা বলছেন, বর্তমান তালিকাটি ইউপিএ জমানায় সরকারের হাতে এসেছিল। এমন নয় যে, মাত্র এই ক’জনেরই বিদেশে কালো টাকা রয়েছে। মোদী সরকার কূটনৈতিক দৌত্যের মাধ্যমে নতুন তালিকা সংগ্রহ করতে পারছে কি না সেটাই দেখার।”
প্রকাশ্যে এ সব বললেও কংগ্রেসের অন্দরে আফশোসটাই আজ ধরা পড়েছে। দলের এক নেতা স্পষ্ট মেনেই নেন, মনমোহন সরকার প্রশাসনিক কৌশলের সাবেকি পথ নিয়ে ভুলই করেছিল। ২০১১ সালে ফ্রান্স সরকারের কাছ থেকে নামের তালিকা পেয়েছিল সরকার। তখনই আদালতে তা পেশ করা উচিত ছিল।
তবে কিছুটা আফশোস করছেন বিজেপি নেতৃত্বও। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথায়, “একটু কৌশলগত ভুল হয়েছে আমাদেরও। আনুষ্ঠানিক ভাবে সিট গঠনের পর দিনই কমিটির কাছে ৬২৭ জনের তালিকা পেশ করা হয়। সে কথা তখনই ঘোষণা করা উচিত ছিল। তা করলে সুপ্রিম কোর্টের অসন্তোষের মুখেও পড়তে হতো না সরকারকে।”