অগ্নিপরীক্ষায় বরাক-৩

বরাক কিংবা ব্রহ্মপুত্র, উড়তে বসেছে বাংলাভাষীদের ঘুম

মাঠে-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে, রেলগাড়ি-বাসে—সর্বত্র এক চর্চা, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি। নাগরিক পঞ্জি নবায়নের নামে অসমে বসবাসকারী ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে বঙ্গভাষীদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার মুখে। ব্রহ্মপুত্র কি বরাক উপত্যকার বাঙালিরা আজ চরম অনিশ্চয়তায়।

Advertisement

বিনোদলাল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৫ ০২:৪০
Share:

বিনোদলাল চক্রবর্তী

মাঠে-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে, রেলগাড়ি-বাসে—সর্বত্র এক চর্চা, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি। নাগরিক পঞ্জি নবায়নের নামে অসমে বসবাসকারী ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে বঙ্গভাষীদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার মুখে। ব্রহ্মপুত্র কি বরাক উপত্যকার বাঙালিরা আজ চরম অনিশ্চয়তায়। চরম উত্কন্ঠায় রাতের ঘুম উবে গিয়েছে তাদের।

Advertisement

নাগরিক পঞ্জি নবায়নের এই কাজ সারা দেশে হওয়ার কথা। শুরু হয়েছে অসমে। আপাতত এ রাজ্যেই সীমাবদ্ধ। উদ্দেশ্য, প্রকৃত ভারতীয়দের নাম নাগরিক পঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত করা। যাদের নাম এই তালিকা থেকে বাদ পড়বে, তারা নাগরিকত্ব হারাবেন। বিদেশি আখ্যায় চিহ্নিত হবেন।

অসমে প্রায় এক কোটি বাঙালির বাস। অন্য জনজাতি অর্থাত্ বড়ো, ডিমাসা, কার্বি, লালুং, মিরি ও অন্য ভাষিকগোষ্ঠী সহ চা-জনগোষ্ঠীর মিলিত জনসংখ্যা আরও এক কোটি বা সামান্য বেশি। বাঙালি ও অন্য অ-অসমিয়াদের বাদ দিলে অসমিয়ারা এই রাজ্যে সংখ্যালঘু। কিন্তু ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অসমিয়ারাই এখানকার শাসক। এ নিয়ে অন্য ভাষিক গোষ্ঠী কোনও দিন আপত্তি বা ক্ষোভ প্রকাশ করেনি। যাদের ক্ষোভ প্রবল ছিল তারা ইতিমধ্যে পৃথক রাজ্য পেয়েছে। যেমন নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মেঘালয়। বর্তমানে বড়ো, ডিমাসা ও কার্বি জনজাতিদের মধ্যে ক্ষোভ প্রকট। তারাও পৃথক রাজ্যের দাবিতে অনড়।

Advertisement

অন্য দিকে, বাংলাদেশি সন্দেহে অসমের বঙ্গভাষীদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া অনেক দিন আগেই শুরু হয়েছে। যাকে-তাকে সন্দেহভাজন হলে ভোটারতালিকায় ডাউটফুল বা ‘ডি’ চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। প্রায় দু’লক্ষ বাঙালি ‘সন্দেহজনক ভোটার’ হয়ে ট্রাইব্যুনালের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদের বিচার প্রক্রিয়া কবে শেষ হবে, তা অনিশ্চিত। এখন এনআরসি-র নামে আর এক প্রস্থ যন্ত্রণার মুখে তাঁরা পড়েছেন।

আসাম পাবলিক ওয়ার্কস নামে একটি অসমিয়া সংগঠন অসম চুক্তি রূপায়ণের আর্জি জানিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে রিট পিটিশন পেশ করেছিল। তারই অঙ্গ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট অসমে এনআরসি নবীকরণের নির্দেশ জারি করেছে। কী ভাবে এই নাগরিক পঞ্জি তৈরি হবে? রাজ্য সরকারকে বলা হল শর্তাবলি প্রস্তুত করে তাদের জানাতে। সুপ্রিম কোর্ট সেই শর্তাবলি হুবহু অনুমোদন করে।

রাজ্য সরকার বিভিন্ন মাধ্যমে বড় বড় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করল, নাগরিক পঞ্জির আবেদনপত্র অতি সহজ। বলা হল, চলতি বছরের মার্চ মাসে নাগরিক পঞ্জি নবায়নের আবেদনপত্র ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হবে। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নির্দিষ্ট সেবাকেন্দ্রে তা জমা দিতে হবে। বাস্তবে সেই আবেদনপত্র দেওয়া শুরু হয় জুন মাসে। দীর্ঘ চার পাতার আবেদনপত্র হাতে পেয়ে সবাই আঁতকে ওঠেন। এত জটিল আবেদনপত্র ! সেই সঙ্গে যে সব তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে, পূর্বপুরুষের প্রমাণপত্র দাখিল করতে বলা হয়েছে, এ যেন খরস্রোতা বৈতরণী পাড়ি দেওয়ার সামিল। ফলে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।

বর্তমানে কেন্দ্রের শাসনক্ষমতায় বিজেপি ও অসমে কংগ্রেস। বিজেপি বারবার বলছে, বাংলাদেশ থেকে যারা নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে এসেছেন বা আসবেন, তাদের শরণার্থীর মর্যাদা ও নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রী তরুন গগৈও এত দিন সহমত পোষণ করছিলেন। কার্যত আজ পর্যন্ত কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এ বিষয়ে কোনও ভূমিকা পালন করেনি। রাজ্য সরকারও সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা পেশ করতে গিয়ে এর উল্লেখ পর্যন্ত করেনি।

এ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে, যাদের নাম বা পূর্বপুরুষের নাম ১৯৭১-এর ভোটার তালিকায় লিপিবদ্ধ রয়েছে, নাগরিক পঞ্জিতে তাদের নামই নথিভুক্ত হবে। অথবা ১৯৭১-এর ২৪ মার্চের আগের নথি পেশ করতে হবে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ এর ২৪ মার্চ শেখ মুজিবর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। শুরু হয় পাক সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় প্রাণের ভয়ে প্রায় এককোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ১৯৭১-এর ২৫ ডিসেম্বর। প্রকৃত অর্থে, সেদিন থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়। বেশির ভাগ শরণার্থী তখন স্বদেশে চলে যান।

এ বার আসি ২০১৪-র ভোটার তালিকার কথায়। ১৯৮৫-৮৬ ও ১৯৯৬-৯৭ সালে ভোটার তালিকায় ব্যাপক সংশোধন করা হয়েছে। ১৯৬৬-র ভোটার তালিকায় যাদের নাম নেই, তাঁদের বা তাঁদের বংশধরের নাম ভোটার তালিকায় স্থান পায়নি। অর্থাত্ ১৯৬৬ র ভোটার তালিকাকে ভিত্তি করেই ২০১৪-র সংশোধিত ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছে। ফলে সেই ভোটার তালিকায় প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকরাই স্থান পেয়েছেন। এই ভোটার তালিকার ভিত্তিতে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং ২০১৪-র ভোটার তালিকাকে কেন নাগরিক পঞ্জি নবায়নের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হল না ?

আগামী বছর অসমে বিধানসভার নির্বাচন। তাই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির এখন দিশাহীন অবস্থা। এনআরসি নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারছে না তারা। যে যার মতো করে আবোলতাবোল বকছেন। রাজনীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন অসমে বসবাসকারী বাঙালিরা। এমনকী, অন্য রাজ্যের মেয়ে বিয়ে করাতেও বিপত্তি। এই ধরনের মহিলারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হবেন কিনা উদ্বেগে বহু পরিবার। ভারতের অঙ্গরাজ্য, জম্মু ও কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা কি অসমের জন্যও প্রযোজ্য! অসমের বাঙালিমাত্রই আজ ভীতিগ্রস্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে পিঠ। ওপাশেই অন্ধকার খাদ।

এই পরিস্থিতিতে পৃথক বরাকের দাবি আরও জোরালো হচ্ছে। বরাক উপত্যকার চার দিকে রয়েছে মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মণিপুর। দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। নিজ রাজ্যের সঙ্গে সংযোগ বললে একমাত্র ডিমা হাসাও জেলা। এই জেলাই বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার একমাত্র করিডর। সেখানে পৃথক রাজ্যের দাবি ক-দিন পরপরই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ডিমাসা জঙ্গিরা আত্মসমর্পণের জন্য শর্ত চাপিয়ে টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল আদায় করে নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিমা হাসাও জেলাকে পৃথক রাজ্য করতে সক্ষম হলে বরাক উপত্যকা অসম থেকে এমনিতেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। বরাক উপত্যকা পৃথক হলেই এখানকার মানুষ বিদেশি আখ্যা থেকে রেহাই পাবেন। তখন আর তাদের কেউ বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করবে না। সে তো পরের ব্যাপার। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে কী ভাবে রেহাই মিলতে পারে, এ নিয়েই অসমের বঙ্গভাষীরা আজ দিশাহীন ও ভীতিগ্রস্ত।

(লেখক করিমগঞ্জ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী, লোয়ার হাফলং হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক, রবিবারের সাহিত্য আড্ডা-রও প্রধান।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন