Coronavirus

এয়ারপোর্টে যা দেখলাম তা বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো ছাড়া কিছুই নয়

পন্ডিচেরি পৌঁছনর পর পরই কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের বাড়বাড়ন্তের নানান খবরে উদ্বিগ্ন ছিলাম। কিন্তু কলেজ তখনও চলছে। ফোর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষা নিয়ে সবাই সিরিয়াস। করোনাভাইরাস নিয়ে তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না।

Advertisement

সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২০ ১৯:৫৯
Share:

করোনা বিপর্যয়েও স্বাস্থ্যপরীক্ষা এখনও ঢিলেঢালা বিমানবন্দরে। —প্রতীকী চিত্র।

চেন্নাই বিমানবন্দর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার কলকাতাগামী বিমানে গুছিয়ে বসতে না বসতেই পেছনের সারির এক সহযাত্রীর ফোনালাপ কানে এল। মানুষটি উচ্চস্বরে চলভাষের অন্য প্রান্তের মানুষটিকে বলছেন, “দু’বার তো চেক হল, কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি।”

Advertisement

এর পরের বাক্যালাপ শুনে পাশের সিটের সহযাত্রী প্রৌঢ়া সভয়ে মাস্কের ওপরে আঁচল জড়িয়ে নিলেন আর আমি মনে মনে হিসেব করার চেষ্টা করছিলাম দুই আসনের সারির মধ্যেকার দূরত্ব তিন ফুট কি না! তিনি বলছিলেন, যে ম্যাডাম তাঁকে পরীক্ষা করেছেন তিনি এই ব্যক্তিকে আলাদা থাকতে বলেছেন। এ-ও শোনা গেল, দরকার হলে কলকাতায় গিয়ে সোজা হাসপাতালে চলে যাবেন। পাশের সিটের সহযাত্রী অসুখের বিষয়ে জানতে চাইলে ভদ্রলোক বললেন, তেমন কিছুই না! কিন্তু আশঙ্কা আমাদের পিছু ছাড়ল না।

অনেক আগে থেকেই ঠিক করা সাত দিনের পন্ডিচেরি সফর শেষ মুহূর্তে বাতিল করা যায়নি। কারণ আমাদের পুত্র ওখানেই পড়াশোনা করে। নিশ্চিন্তে পন্ডিচেরি পৌঁছনর পর পরই কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের বাড়বাড়ন্তের নানান খবরে উদ্বিগ্ন ছিলাম। কিন্তু কলেজ তখনও চলছে। ফোর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষা নিয়ে সবাই সিরিয়াস। করোনাভাইরাস নিয়ে তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। এ দিকে দোকানে ঢুকলেই সকলকে স্যানিটাইজারে হাত পরিষ্কার করে নিতে হচ্ছে। প্রথম দিকে একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিল।

Advertisement

আরও পড়ুন: রাজ্যে শুরু হয়ে গেল লকডাউন, কাল থেকে কড়া ব্যবস্থা

তবে একটা ব্যাপার বুঝলাম, পন্ডিচেরির মানুষজন খুব ডিসিপ্লিনড। কোনও নির্দেশ এলে তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার স্বভাব মজ্জায় মিশে আছে। অবশেষে কেন্দ্রশাসিত পন্ডিচেরির সরকারি কলেজেও ছুটি ঘোষণা করা হল। পন্ডিচেরির দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা, ছেলের ইনস্টিটিউটের বাঙালি অধ্যাপক আমাকে জানালেন, কলকাতার থেকে এই শহর অনেক বেশি নিরাপদ, তাই ছাত্ররা কলেজ হস্টেলেই থাকবে।

কিন্তু তখন থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলে যাচ্ছিল পরিস্থিতি। অবশেষে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদের হস্টেল থেকে বাড়ি ফিরে যেতে বলা হল। ইতিমধ্যে ১৭ মার্চ এক জনের শরীরে করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ ধরা পড়েছে। ছেলের জন্য একই ফ্লাইটের টিকিট কেটে নেওয়া হল। ২২ মার্চ সকাল ১১-৩০ এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ান। এ দিকে প্রধানমন্ত্রী আইসিএমআর-এর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ‘জনতা কার্ফু’ জারি করেছেন।

উদ্বিগ্ন হয়ে অস্থায়ী বাসস্থান শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের গেস্ট হাউসের পরিচালকদের পরামর্শ চাইতে তাঁরা জানালেন যে জরুরি পরিষেবা বন্ধ হবে না। নিশ্চিন্ত হয়ে হোয়াইট টাউনের সি বিচে গিয়ে অবাক হলাম। একদম শুনশান, কেউ কোত্থাও নেই! কী হয়েছে ভাববার আগেই জলদগম্ভীর স্বরে পুলিশি নির্দেশ এল, সি বিচে যাওয়া মানা! কারণ রবিবারের ‘জনতা কার্ফুর’ প্রস্তুতি হিসেবে শনিবার থেকেই কার্ফু জারি।

পন্ডিচেরির মূল আকর্ষণ ফ্রেঞ্চ কলোনি সংলগ্ন রক বিচ। উইকএন্ডে এখানে মানুষের মেলা বসে। কিন্তু শনিবারের চেহারা সম্পূর্ণ আলাদা। একেবারে জনমানবশূন্য। রবিবার ভোর সাড়ে ৫টায় বেরিয়ে পড়লাম চেন্নাই এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। বিমানবন্দরে পৌঁছে মনে হল যেন হাওড়া স্টেশনে এসেছি। সপরিবার অনেক মানুষই সেখানে কাগজ পেতে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কথা বলে জানলাম, ‘জনতা কার্ফু’র ভয়ে আগের রাত থেকেই তাঁরা বিমানবন্দরে হাজির।

আরও পড়ুন: রাজ্যের এই অবস্থা! করোনা টেস্টের যোগ্য নয় কোনও বেসরকারি ল্যাব

ভ্রমণার্থীর সংখ্যা নগণ্য। বেশির ভাগই চিকিৎসার কারণে গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলা ও বাংলাদেশ থেকে। মুখে মাস্ক থাকলেও বেশির ভাগেরই ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতাবোধ নেই! আরও অবাক হলাম যখন এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ জানালেন, কর্মী কম থাকায় লাগেজ স্ক্যানিং বন্ধ। মনটা কু গাইল, কোনও দেশদ্রোহী এই সুযোগ কাজে লাগাবে না তো!

বোর্ডিং পাশ নিতে গিয়ে আর একপ্রস্থ অবাক হওয়ার পালা। নাম কা ওয়াস্তে এক জনের পরিচয়পত্রে চোখ বুলিয়ে তিনটে বোর্ডিং পাস ইস্যু করা হল। ভেবেছিলাম, এয়ারপোর্টে নিশ্চয়ই সকলের স্বাস্থ্যপরীক্ষা হবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি! লাইন দিয়ে গিয়ে উঠলাম এআই ৭৬৬ এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে সকাল ১১টা ০৫ মিনিটে। তার পর সহযাত্রীর বাক্যালাপ শুনে কাঁটা হয়ে বসে থাকা। উনি কিন্তু একা নন, সঙ্গী ছিলেন জনা ছ’য়েক। কলকাতা এয়ারপোর্টে নেমে স্তম্ভিত হলাম। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে পন্ডিচেরির ছবি দেওয়ায় বন্ধুদের অনেকেই বলেছিল, এয়ারপোর্টে নামলেই আমাদের কোয়রান্টিনে পাঠানো হবে। আমরা প্রস্তুত ছিলাম কিছু টেস্টের জন্য।

কিন্তু আশ্চর্য হলাম, এগজিট গেটের কাছে জনা তিনেক মহিলা থার্মাল স্ক্রিনিং করার চেষ্টা করছেন। অনেকে লাইনে দাঁড়ালেন থার্মাল স্ক্রিনিং-এর জন্য। কিন্তু পাশ থেকে বেরিয়ে গেলেন এমন মানুষের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। রবিবার দুপুর দেড়টা নাগাদ এয়ার ইন্ডিয়ার চেন্নাই-কলকাতা উড়ান ছাড়া আর কোনও বিমান নেমেছে কি না জানা নেই।

আমার সামনে থাকা এক মহিলা মুখে জল দিয়ে স্ক্রিনিং করতে এসেছিলেন। পরীক্ষক তাঁকে বার বার মুখ মুছে নিতে বললে তিনি জানান, ‘তবিয়ত ঠিক নেহি।’ এর পর তিনি ‘বাদ মে’ বলে থার্মাল স্ক্রিনিং না করেই বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ওই তিনটি মেয়ের পক্ষে অনিচ্ছুকদের পরীক্ষা করা সত্যিই সম্ভব নয়। এয়ার ইন্ডিয়া করোনা ফি হিসেবে ৩১৯ টাকা চার্জ করেছেন।

কিন্তু কিসের ভিত্তিতে এই চার্জ তা-ও বোঝা গেল না! শুধুমাত্র জ্বর মাপলেই কি কোভিড-১৯ আছে কি না বোঝা যায়? তা-ও তো এক জন অস্থায়ী কর্মীও নিয়োগ করেননি। আমরা তিন জন সেলফ কোয়রান্টিনে গৃহবন্দি আছি। কিন্তু আমাদের অনেক সহযাত্রীও কি সেই সচেতনতা সত্যিই আছে?

আর সেই ভদ্রলোক যাঁকে কলকাতার হাসপাতালে যেতে বলা হয়েছিল, তিনি জনারণ্যে হারিয়ে গেলেন। একটা ঘটনা দেখেছি, তাতেই ভয় পাচ্ছি! আমার ছেলের ইনস্টিটিউটের যে ১২ জন ছাত্রছাত্রী দমদম, হলদিয়া, বেহালাতে ফিরল ভিড় ট্রেনে, তারাও হয়তো বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু ট্রেনের অন্য যাত্রীরা? ফ্লাইট, ট্রেন, দোকান-বাজার সব অবিলম্বে বন্ধ না হলে আমরা অচিরেই কোভিড-১৯ ভাইরাস অ্যাটাকের স্টেজ থ্রি-তে পৌছে যাব! মারণ ভাইরাস ছাড়বে না আমাদের!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন