Community Transmission

গোষ্ঠী সংক্রমণে কেন্দ্রের ‘আপত্তি’র পিছনে দুই অঙ্ক

গত সপ্তাহে কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন জানিয়েছিলেন, তাঁর রাজ্যের বেশ কিছু এলাকায় গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২০ ০৪:১১
Share:

ছবি এএফপি।

দেশে করোনার সংক্রমণ আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় ১২ লক্ষ ছাপিয়ে গিয়েছে। রোজ ৪০ হাজারের কাছাকাছি নতুন রোগী। কেরল ও পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য জানিয়ে দিয়েছে, সেখানকার কিছু এলাকায় গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই কথাটিই নরেন্দ্র মোদী সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রক স্বীকার করতে রাজি নয়। যত বারই গোষ্ঠী-সংক্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তা খারিজ করেছেন কেন্দ্রীয় কর্তারা।

Advertisement

গত সপ্তাহে কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন জানিয়েছিলেন, তাঁর রাজ্যের বেশ কিছু এলাকায় গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে। দিন দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘কোভিড-১৯ ছড়াচ্ছে। ক্রমশ মনে করা হচ্ছে, গোষ্ঠীতেও সংক্রমণ ছড়ানো শুরু হয়েছে। বিভিন্ন স্তরের বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, সব সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে আলোচনা করে ধারণা করা হচ্ছে, কিছু কিছু এলাকায় গোষ্ঠী-সংক্রমণ হচ্ছে।’’ প্রশ্ন হল, স্বাস্থ্য যেখানে রাজ্যের এক্তিয়ারের বিষয় এবং করোনা-সংক্রমণ রুখতে না-পারাটা যেখানে মূলত রাজ্যের ব্যর্থতা বলেই গণ্য হওয়ার কথা, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ বা কেরলের মতো বিরোধী-শাসিত রাজ্যের ক্ষেত্রেও গোষ্ঠী-সংক্রমণের কথা কেন মানছে না এনডিএ সরকার?

বিশেষজ্ঞদের মতে, এর দু’টি দিক আছে। একটি রাজনৈতিক, অন্যটি চিকিৎসা সংক্রান্ত রণকৌশল তথা আইনশৃঙ্খলাজনিত। প্রথম দিকটির ব্যাখ্যা হল, দেশের কোনও প্রান্তে গোষ্ঠী-সংক্রমণের কথা কেন্দ্রীয় ভাবে স্বীকার করা হলেই বিরোধী দলগুলি শাসক শিবিরের নীতির ব্যর্থতা নিয়ে আক্রমণের সুযোগ পেয়ে যাবে। মোদী সরকার সেটি চায় না। অন্য দিকটি হল, গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলে ঘোষণা হলেই দেশ জুড়ে আতঙ্কেরপরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। দেখা দিতে পারে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা। কারণ, কোভিড আদতে অতিমারি। করোনা সংক্রমণ শুনলেই মৃত্যুভয় পান অধিকাংশ মানুষই।

Advertisement

দিল্লি এমসের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক-চিকিৎসক আশুতোষ বিশ্বাস বলেন, ‘‘গোটা দেশে আজকের দিনেও ঘরে-ঘরে গিয়ে পরীক্ষা, কোনও রোগী কোথা থেকে সংক্রমিত হলেন তা খতিয়ে দেখা (কনট্যাক্ট ট্রেসিং)-র ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সংক্রমণ বেশি, এমন এলাকাগুলিকে গণ্ডিবদ্ধ করে সিল করে দেওয়া হচ্ছে। যাতে সংক্রমণ বাইরে না-ছড়াতে পারে। বাড়ানো হচ্ছে পরীক্ষার সংখ্যাও। কিন্তু এক বার গোষ্ঠী-সংক্রমণের ঘোষণা হলে এ সব বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থহীন হয়ে পড়বে সংক্রমণ রোখার সমস্ত চেষ্টা। তখন সম্পূর্ণ নতুন করে প্রোটোকল তৈরি করতে হবে।’’ কেমন সেই প্রোটোকল? চিকিৎসকদের মতে, গোষ্ঠী-সংক্রমণ ঘোষণা হয়ে গেলে করোনা পরীক্ষা, সংক্রমিতদের খুঁজে বার করে তাঁদের নিভৃতবাসে পাঠানো— এই সমস্ত উদ্যোগের বদলে সরকারের অগ্রাধিকারই হবে চিকিৎসা এবং রোগীদের প্রাণ বাঁচানো।

গোষ্ঠী-সংক্রমণ

ব্যাপক সংক্রমণের সময়ে কোনও বড় এলাকা বা রাজ্যের ক্ষেত্রে যদি একাধিক তল্লাট চিহ্নিত হয় এবং সে ক্ষেত্রে যদি সংক্রমণের কোনও নির্দিষ্ট শৃঙ্খলাবদ্ধ উৎস না-থাকে, তা হলে গোষ্ঠী-সংক্রমণ হয়েছে ধরা যেতে পারে।

সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

কিন্তু সরকারের দাবি, এখনও সেই পরিস্থিতি আসেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংক্রমণের উৎস এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, সংক্রমণের উৎস খুঁজে না-পাওয়া গেলে গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেত। এ কথা ঠিক যে, শহর বা গ্রামের কোনও এলাকা, পাড়া বা আবাসনে একসঙ্গে একাধিক সংক্রমণের ঘটনা সামনে আসছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেখানে গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হয়েছে। সেগুলি স্থানীয় পর্যায়ের সংক্রমণ, যা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। গোষ্ঠী-সংক্রমণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সেই পরিস্থিতি হতে না-দেওয়াটাই এখন সরকারের লক্ষ্য।

আরও পড়ুন: রাজ্যে এক দিনে সর্বাধিক করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তাদের মতে, দিল্লির নিজামুদ্দিন বা মুম্বইয়ের ধারাভির মতো এলাকায় স্থানীয় পর্যায়ে সংক্রমণ হয়েছিল। কিন্তু তা ওই এলাকাতেই আটকে দেওয়া গিয়েছে। মনে রাখতে হবে, সত্যিই গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হলে রোগীরা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তেন। কেন্দ্রের দাবি, দেশের মাত্র পঞ্চাশটি জেলায় আশি শতাংশ রোগী আছেন। ফলে গোটা দেশে গোষ্ঠী-সংক্রমণ হয়েছে, এমন কথা কোনও ভাবেই বলা যায় না। সংক্রমণের হার ক্রমশ কমছে বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি রাজেশ ভূষণও।

আরও পড়ুন: রাজ্যে লকডাউন: গা-ছাড়া মনোভাব নিয়েই চিন্তা আজ

কেন্দ্রের এই বক্তব্য সত্ত্বেও অবশ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু না-হলে রোজ ৪০ হাজারের কাছাকাছি সংক্রমণ হওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া, যে কোনও নতুন ভাইরাস যখন আক্রমণ শানায়, তখন তা ধাপে ধাপে গোষ্ঠী-সংক্রমণের পথ ধরেই শেষমেশ স্থানীয় পর্যায়ের রোগে পরিণত হয়। এই ক্রম মেনে আগামী দিনে কোভিডও স্থানীয় রোগে পরিণত হবে। তখন করোনা-সংক্রমণ নিয়ে চিন্তার কিছু থাকবে না। তাই আজ না-হলেও কাল গোষ্ঠী-সংক্রমণ হবেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কথা সরকারও জানে। তাই সংক্রমণ পুরোপুরি লাগামছাড়া হয়ে ওঠার আগেই চেষ্টা চলছে প্রতিষেধক আবিষ্কারের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন