coronavirus

শেষকৃত্যের জন্য শ্মশানে মৃতদেহের লাইন, ফ্রিজে বাবার দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছেলে, ভয়াবহ পরিস্থিতি দিল্লিতে

গত সাত দিনেই দিল্লিতে করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজারের বেশি মানুষ।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২১ ১৫:৪৩
Share:

শ্মশানের চাতালে মৃতদেহের লাইন। ছবি: পিটিআই।

চিকিৎসা পেতে প্রথমে হাসপাতালের বাইরে লাইন দিতে হয়েছিল। মৃত্যুর সঙ্গে যখন পাঞ্জা লড়ছেন, তখন হাসপাতালের বাইরে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের পরিজনরা। মৃত্যুর পরেও সেই লাইন থেকে নিস্তার পেলেন না দিল্লিতে করোনার কবলে প্রাণ হারানোরা। চিতায় ওঠার জন্যও মাচায় শুয়ে থাকা অবস্থাতেই শ্মশানে লাইন দিতে হল তাঁদের। অতিমারিতে বিধ্বস্ত রাজধানীতে এ বার এমনই দৃশ্যই সামনে এল।

Advertisement

৪০ ডিগ্রির উপরে হাঁসফাঁস করা গরমে মঙ্গলবার দিল্লিতে কী দৃশ্য ধরা পড়ল? সুভাষনগর শ্মশানে টিনের চালের নীচে সারি সারি চিতা জ্বলছে। মিহি ছাই উড়ে এসে পড়ছে পাশের চাতালেও। আর খাঁ খাঁ রোদে তেতে ওঠা সেই চাতাল ধরেই এগিয়েছে মৃতদেহের সর্পিল রেখা। এক ঝলক তাকালেই মাচার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা ১৫-২০টি দেহ চোখে পড়তে বাধ্য। পাশের উঁচু বাঁধানো জায়গায় ঘি এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে বসে রয়েছেন পরিজনরা। এক দু’ঘণ্টা নয়, ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টা বসে রয়েছেন কেউ কেউ। যে প্লাস্টিকের থলিতে মৃতদেহ মোড়া রয়েছে, তার উপর নাম, নম্বর লেখা থাকায় হাতছাড়া হওয়ার ভয় নেই। তাই একটানা বসে না থেকে বাইরে থেকে মাঝেমধ্যে পোড়া দেহের গন্ধ এবং ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে আসছেন অনেকে।

কিন্তু বাইরে বেরিয়েও যে প্রাণভরে শ্বাস নেবেন তার উপায় নেই। সেখানেও মৃতদেহ নিয়ে সারি সারি অ্যাম্বুল্যান্স এবং গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তখনও ধাক্কা সামলে উঠতে না পারা কয়েক জন ফোঁপাচ্ছেন। কোনখানে দাঁড়াবেন বুঝতে পারছেন না। তাতে বাকিরাও রীতিমতো অপ্রস্তুত। এমন সময় বেরিয়ে এলেন শ্মশানের এক কর্মী। কড়া স্বরে বললেন, ‘‘অপনা অপনা ডেড বডি উঠাও অউর উধর লাইন মেঁ জা কে খড়ে হো জাও।’’ তাতে প্লাস্টিকে মোড়া বাবার দেহের উপর চন্দনকাঠ সাজাতে গিয়ে থতমত খেয়ে গেলেন এক মহিলা। কোনটা নাভি আর কোনটা বুক, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তাঁকে ধমক লাগালেন অন্য এক শ্মশানকর্মী। তাতে ফুঁপিয়ে উঠলেন ওই মহিলা। কান্না চাপতে চাপতে বললেন, ‘‘বাবার মুখটা পর্যন্ত দেখতে পাইনি।’’

Advertisement

সারি সারি দেহ। ছবি: পিটিআই।

দিল্লি সরকারের হিসেব অনুযায়ী, মাস দুয়েক আগেও পরিস্থিতি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে ৫৭ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়। মার্চে সংখ্যাটা বেড়ে হয় ১১৭। কিন্তু এপ্রিল মাস এখনও শেষ হয়নি, তাতেই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ৩ হাজার ৬০১ রোগী মারা গিয়েছেন। এর মধ্যে গত ৭ দিনেই মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ২৬৭ জনের। যদিও সরকারি পরিসংখ্যান নিয়েও গরমিলের অভিযোগ উঠে আসছে।

সোমবার বিকেলে সুভাষনগর শ্মশানে কোভিডে মারা যাওয়া বাবার দেহ নিয়ে গিয়েছিলেন বছর চল্লিশের মনমীত সিংহ। সংবাদমাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন, অ্যাম্বুল্যান্স, গাড়ির ভিড় কাটিয়ে শ্মশানে ঢুকতে যাবেন, তার আগেই রাস্তা আটকান এক কর্মী। জানিয়ে দেন, আর দেহ নেওয়া যাবে না। কারণ এত দেহ লাইনে রয়েছে যে, সোমবার সব ক’টি দেহ দাহ করার জায়গা এবং কাঠ নেই। আর সিএনজি চুল্লিতে একসঙ্গে দু’টোর বেশি দেহ করা যায় না। তাতেও এক একটি দেহের পিছনে কমপক্ষে ৯০ মিনিট সময় লাগবে। ইতিমধ্যেই লাইনে ২৪টি দেহ রয়েছে। তাই অন্য কোথাও যেতে হবে তাঁকে।

বাধ্য হয়ে ছ’কিলোমিটার দূরে পশ্চিম বিহার এলাকার শ্মশানের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। পুরসভাকে ধরে সেখানেই শেষমেশ বাবার দেহ দাহ করেন। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মনমীত বলেন, ‘‘সরকার হাসপাতালে অক্সিজেন দিতে পারবে না। অন্তত শ্মশানে জায়গা তো দিক, যাতে পৃথিবী থেকে বিদায়টা অন্তত ঠিকঠাক হয়!’’

গণচিতা জ্বলছে। ছবি: পিটিআই।

সোমবার সন্ধ্যায় সুভাষনগর শ্মশানে বাবার দেহ নিয়ে আসেন ব্যবসায়ী আমন অরোরাও। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাবা এমএল অরোরার মৃত্যু হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে গেলে আগে কোভিড রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা করার আগেই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় তাঁর। তার পর সন্ধ্যা পেরনোর আগেই শ্মশানে এসে পৌঁছন তিনি। কিন্তু মঙ্গলবার সকালের আগে দাহ করা সম্ভব নয় বলে তাঁকে জানিয়ে দেন শ্মশানের কর্মীরা। কিন্তু তত ক্ষণে পচন ধরতে পারে ভেবে একটি ফ্রিজ ভাড়া করে শ্মশানের বাইরেই বাবার দেহ সংরক্ষণ করে রাখেন তিনি। মঙ্গলবার বিকেলে শেষমেশ বাবার সৎকার করতে পারেন তিনি।

তবে শুধু সুভাষনগর নয়, দিল্লির প্রত্যেক শ্মশানেরই একই অবস্থা বলে ভূরি ভূরি অভিযোগ। তাতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দেওয়া নিয়ে কেন্দ্রের পাশাপাশি অরবিন্দ কেজরীবাল সরকারের প্রস্তুতি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কেজরীবাল যদিও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিপর্যয়ের কথা মেনে নিয়েছেন। গত ১০ দিনে যত কোভিড রোগীর মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই অক্সিজেনের অভাবে মারা গিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। কিন্তু এই অক্সিজেনে ঘাটতি নিয়েও কেন্দ্র এবং দিল্লি সরকারের মধ্যে দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের পালা চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন