কাচ-জলে থইথই, কাগজ পেতে আশ্রয় মা ও শিশুর

 ১৪ দিনের বাচ্চাকে নিয়ে চিকিৎসকের ঘরের দিকে ছুটছিলেন এম পূজা। কোনও মতে বললেন, ‘‘যে ওয়ার্ডে ছিলাম, সেখানে কাচ ভেঙে বৃষ্টির জল ঢুকে গিয়েছে। বাচ্চাটা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’’

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

পুরী শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৯ ০৩:৪৬
Share:

বিপর্যয়: ঝড়ে ক্ষতি হয়েছে পুরী হাসপাতালের। চলছে মেরামতি। শনিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

১৪ দিনের বাচ্চাকে নিয়ে চিকিৎসকের ঘরের দিকে ছুটছিলেন এম পূজা। কোনও মতে বললেন, ‘‘যে ওয়ার্ডে ছিলাম, সেখানে কাচ ভেঙে বৃষ্টির জল ঢুকে গিয়েছে। বাচ্চাটা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’’

Advertisement

হাসপাতালে ‘মাদার-চাইল্ড কমপ্লেক্স’-এর সাত তলায় ভর্তি ছিলেন নলিনী বেহরাও। সঙ্গে ১০ দিনের ছেলে। কাল ঝড়ের জেরে সাত তলার জানলার কাচ ভেঙে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ঘরের মধ্যে। তারপর থেকে নলিনী ও ওয়ার্ডের অন্যদের ঠাঁই হয়েছে ভবনের চার তলার মেঝেয়। সেখানেই সদ্যোজাত সন্তানকে দেখভাল করছেন, স্তন্যপান করাচ্ছেন তাঁরা। বাড়ি থেকে আনা কাপড়ে কেউ কোনওমতে বসেছেন, কেউ কোনও ভাবে জোগাড় করেছেন কিছু কাগজ। সেটাই আপাতত মা-সন্তানের আশ্রয়স্থল!

ফণীর দাপটে এমনই অবস্থা পুরীর জেলা সদর হাসপাতালের! ২০১৫ সালে নির্মিত হাসপাতালের ১০০ শয্যার ‘মাদার-চাইল্ড কমপ্লেক্স’-এর ছিন্নভিন্ন অবস্থা। কমপ্লেক্সের সমস্ত ওয়ার্ডে জলভর্তি। শয্যা ফাঁকা। দেখে বোঝার উপায় নেই, ২৪ ঘণ্টা আগেই এই সব ওয়ার্ড ছিল রোগী ও পরিবারের লোকজনে ভর্তি। এদিন নোংরা জল, বৃষ্টির জল জমে একাকার। তারই মধ্যে যেটুকু শুকনো, যেটুকু ফাঁকা জায়গা, সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন নলিনীরা। সকাল থেকে সাফাইকর্মীরা কাজ করছেন বটে, কিন্তু জলমগ্ন অবস্থা কবে কাটবে, বলতে পারছেন না কেউই!

Advertisement

হাসপাতালের অন্য বিভাগগুলিরও অবস্থা একই। ফণীর দাপটে হাসপাতালের মূল প্রবেশদ্বারই ভেঙে পড়েছে। আর তা এমন ভাবে ভেঙেছে যে অ্যাম্বুল্যান্স পর্যন্ত যেতে পারছে না সেখান থেকে। পুরো চত্বর জুড়েই একাধিক বড়-বড় গাছ উপড়ে পড়েছে। পড়ে রয়েছে বিদ্যুতের খুঁটিও। চতুর্দিকে তারের জঞ্জাল। সে সব ডিঙিয়েই এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রোগীদের। আইসিইউ-য়ে যে ক’জন রোগী ভর্তি ছিলেন, তাঁদের সেখান থেকে সরিয়ে অন্যত্র রাখা হয়েছে। অনেকের পরিবার আবার হাসপাতালের অবস্থা দেখে ভরসা রাখতে পারেনি। রোগীকে এসে নিয়ে গিয়েছে। পুরো আইসিইউ এখন ফাঁকা, অন্ধকার। বিভাগের কর্মীদের মুখে কুলুপ। একজন শুধু বললেন, ‘‘নিজেরাই তো সব দেখছেন। এখন এখানে কোনও রোগী নেই। বাকি সব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলবেন।’’

হাসপাতালে সাফাইয়ের সুপারভাইজার বনবিহারী নায়েক বলছিলেন, ‘‘১৯৯৯ সালেও ঝড় হয়েছিল। কিন্তু এমন হয়নি। জানলা-দরজা সব খেলনার মতো ভেঙে পড়েছে। গতকাল থেকে সাফাইয়ের পাশাপাশি আমাদের যত লোক রয়েছেন, সকলে মিলে রোগীদের সরানোর কাজ করছেন তাঁরা।’’ কিন্তু করলে কী হবে, পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে ঝড়ে আহতেরা নতুন করে ভর্তি হতে আসায়, জানাচ্ছেন হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ। ঝড়ের সময় কারও পায়ের উপর চাঙড় ভেঙে পড়ে আঙুল থেঁতলে গিয়েছে পুরোপুরি, কারও মাথার উপরে ইট এসে পড়েছে। মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে সকলে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছেন। হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত সেন্ট জনস অ্যাম্বুল্যান্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার পুরুষোত্তম বর বললেন, ‘‘আমাদের কাছে এখনও ঝড়ে দু’জনের প্রাণহানি এবং প্রায় ২০০ জনের বড় ধরনের শারীরিক আঘাতের খবর রয়েছে।’’ যদিও জেলা প্রশাসন সূত্রে প্রাণহানি বা অন্য কোনও গুরুতর আহতের খবর সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা হয়নি। কারণ, এদিনও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিকলই রয়েছে বলে বক্তব্য প্রশাসনের।

পরিস্থিতি কী ভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তা নিয়ে এদিন দফায়-দফায় বৈঠক করেছেন হাসপাতালের পদস্থ কর্তারা। কর্মীদের ছোট-ছোট দলে ভাগ করে দিয়ে কাজও শুরু হয়েছে। হাসপাতালের ম্যানেজার শর্মিষ্ঠা পণ্ডা বললেন, ‘‘এখনই বিস্তারিত ভাবে কিছু বলা যাবে না। আমরা এখন শুধু চাইছি সব রোগীরা যেন আগে জল আর খাবারটা পান।’’

আর চিকিৎসা? আইসিইউ-য়ে ছিল‌েন যোগেশ কুমার দাস। বছর আটচল্লিশের যোগেশ বললেন, ‘‘কাল ঝড়ের সময়ে প্রবল আওয়াজ করে কাচ ভেঙে পড়ল। আমরা ছ’জন তখন ছিলাম। পুরো ঘর জলে ভর্তি হয়ে গেল। পরে আমাদের সরানো হল। পাঁচজনকে সার্জারি বিভাগে রাখা হয়েছে। আমাকে মেডিসিনে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত চিকিৎসা পাইনি!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন