Mamata Banerjee

তুমুল হর্ষধ্বনি, বলিউডি গানের প্যারোডি, মমতা সমাবেশে পৌঁছতেই উৎসবের মেজাজ কেজরীবালের মঞ্চে

শরদ পওয়ার, শরদ যাদব, ফারুক আবদুল্লা, চন্দ্রবাবু নায়ডু— ভারতীয় রাজনীতির মহারথীরা বুধবার হাজির হয়েছিলেন নয়াদিল্লির যন্তর-মন্তর রোডের সমাবেশ মঞ্চে। কাউকেই এ ভাবে স্বাগত জানানো হয়নি, যে ভাবে অভ্যর্থনা পেলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৪:৩৭
Share:

মঞ্চে মমতা আসতেই তৈরি হল উৎসবের আবহ। ছবি: পিটিআই।

একেবারে ক্রিকেটীয় টাইমিং। ভাষণ শেষ করে সবে যন্তরমন্তর ছেড়েছেন সীতারাম ইয়েচুরি, ডি রাজা। পরবর্তী বক্তার নাম ঘোষণা করার ফাঁকে কয়েকটা গরমাগরম কথা বলছেন আম আদমি পার্টির (আপ) নেতা তথা বুধবারের সভার সঞ্চালক সঞ্জয় সিংহ। ঠিক তখনই খবর পৌঁছল— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছে গিয়েছেন।

Advertisement

খবরটা পাওয়া মাত্র যেন উদ্বেল হয়ে উঠলেন সঞ্চালক। জমায়েতকে তৎক্ষণাৎ জানালেন কথাটা এবং বললেন, ‘‘সবাই হাততালি দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বাগত জানান। এমন ভাবে হাততালি দিন, যাতে মঞ্চে পৌঁছনোর আগেই তাঁর কাছে আওয়াজ পৌঁছে যায়।’’

শরদ পওয়ার, শরদ যাদব, ফারুক আবদুল্লা, চন্দ্রবাবু নায়ডু— ভারতীয় রাজনীতির মহারথীরা বুধবার হাজির হয়েছিলেন নয়াদিল্লির যন্তরমন্তর রোডের সমাবেশ মঞ্চে। কাউকেই এ ভাবে স্বাগত জানানো হয়নি, যে ভাবে অভ্যর্থনা পেলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগমন শুধু আগাম করতালিতে বন্দিত হল, এমন কিন্তু নয়। মমতা মঞ্চে পৌঁছতেই উৎসবের আবহ তৈরি করলেন আয়োজকরা। লুকিয়ে রাখা আয়োজন প্রকাশ্যে আনল কেজরী ব্রিগেড। জনপ্রিয় বলিউডি ছবির ততোধিক জনপ্রিয় একটি গানের প্যারোডি যে বানিয়ে রাখা হয়েছিল, তা আগে টের পাওয়া যায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে উঠতেই সেই প্যরোডি বাজতে শুরু করল— ও মোদী দিল্লি কে লিয়ে তু তো হানিকারক হ্যায়...। গোটা গানটা চলল। গোটা মঞ্চ,গোটা জমায়েত চওড়া হাসি নিয়ে উপভোগ করল সে গান। তার পরে ফের শুরু হল সভা।

আরও পড়ুন: বিধায়ক খুনে এখনই ধরা যাবে না মুকুলকে

প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে নানা রকম সম্ভাবনার কথা আলোচনায় রয়েছে বিরোধী শিবিরে। নির্বাচনের পরে মিলিজুলি সরকার গঠনের পরিস্থিতি এলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন কি না, তা নিয়ে কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত জল্পনা রয়েছে। মমতা নিজে কংগ্রেসকে বা রাহুল গাঁধীকে জোটের মুখ হিসেবে তুলে ধরতে রাজি না থাকায়, সে জল্পনা আরও অক্সিজেন পেয়েছে। এ দিনের সমাবেশ থেকে ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা তথা জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা বার্তা দিতে চাইলেন— প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সে কথা পরে ভাবা যাবে, আগে মোদীকে হঠান। ফারুকের সেই বার্তা প্রশংসিত হল ঠিকই। কিন্তু বিরোধী শিবিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটা অলিখিত স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়ার আবহও তৈরি হয়ে গেল।

যন্তরমন্তরের সমাবেশে প্রায় প্রত্যেক নেতা নিজের ভাষণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিষয়ে দু-চার কথা আলাদা ভাবে খরচ করতে বাধ্য হলেন। সপার অন্যতম শীর্ষনেতা তথা অখিলেশ যাদবের কাকা রামগোপাল যাদব বললেন, ‘‘মমতা সংঘর্ষের প্রতিমূর্তি।’’ বললেন, ‘‘পৃথিবীর কোথাও এমন ঘটতে দেখেছেন যে, সিবিআই যাচ্ছে পুলিশ কমিশনারকে গ্রেফতার করতে?’’ রাষ্ট্রীয় লোক দলের ত্রিলোক ত্যাগী বললেন, ‘‘মঞ্চে রয়েছেন মমতা দিদি, যাঁকে এখন মোদী ভয় পেয়ে গিয়েছেন।’’ আর আপের সঞ্জয় সিংহ বললেন, ‘‘কলকাতার ব্রিগেডে মমতা দিদি যে র‌্যালি করেছিলেন, সেখানে যে লক্ষ লক্ষ লোক এসেছিলেন, তা দেখে মোদীর তোতা উড়ে গিয়েছিল। আর তার পরে আমরা সবাই জানি, মোদীর তোতারা পৌঁছে গিয়েছিল কলকাতায়, পুলিশ কমিশনারকে গ্রেফতার করতে।’’

আরও পড়ুন: কুণাল কি তৃণমূলে? প্রশ্ন এবং বিড়ম্বনা

এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পওয়ার থেকে ন্যাশনাল কনফারেন্সের ফারুক আবদুল্লা, কংগ্রেসের আনন্দ শর্মা থেকে অরুণাচলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গেগং আপাং— প্রবীণ নেতাদের প্রত্যেকের ভাষণে ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সমীহ। এ দিনের সভার আয়োজক হিসেবে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালকে বিশেষ ধন্যবাদ অনেকেই দিচ্ছিলেন। তার পাশাপাশি মমতার বিশেষ ভূমিকার কথাও মনে করালেন শরদ পওয়ার। ‘‘দেশ, গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় যে লড়াই দরকার, সেই লড়াইয়ের পথ দেখালেন মমতা ও কেজরীবাল।’’ মন্তব্য করলেন পওয়ার। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তথা তেলুগু দেশম প্রধান চন্দ্রবাবু অকপটে জানালেন— কলকাতায় যে বিশাল সমাবেশের আয়োজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিলেন, অত বড় সমাবেশ তিনি কখনও দেখেননি।

এর পরে ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের ভাষণের পালা। ‘বঙ্গাল কি শেরনি’, ‘আয়রন লেডি’, এমন নানা বিশেষণে আখ্যায়িত করে তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ জানালেন আপ নেতৃত্ব। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাষণের শুরুতেই দাবি করলেন— আর বেশি দিন নয়, ২০-২২ দিন রয়েছে মোদী সরকারের আয়ু। মমতার আহ্বান— কেউ ভয় পাবেন না।

‘‘আমরা কাপুরুষ নই। কী করবে? জেলে পাঠাবে? কী করবে? খুন করবে? কী করবে? এজেন্সি পাঠাবে? আমি ভয় পাই না।’’ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মমতা। হর্ষধ্বনিতে হইহই করে উঠল যন্তরমন্তরের জমায়েত।

নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন ভাষণে নরেন্দ্র মোদীর প্রতি কটাক্ষ ততই বাড়ছে। দিল্লির সমাবেশেও তার ব্যতিক্রম হল না। মমতা জানালেন, এ দিন তিনি সংসদের সেন্ট্রাল হলে গিয়েছিলেন এবং দেখেছেন যে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর একটি সুন্দর ছবি লাগানো হয়েছে। সে ছবির এবং বাজপেয়ীর প্রশংসাই করলেন মমতা। তার পরেই ফিরলেন কটাক্ষে এবং বললেন, ‘‘আমি একটু আউটস্পোকেন, একটু উল্টোপাল্টা বলে দিই। আমি ওই ছবিটা দেখার পরে বললাম— একটু তো জায়গা রাখো, মোদীর ফটোটাও তা লাগাতে হবে।’’

নিজের ভাষণের ছত্রে ছত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন— মোদী বিরোধী ব্রিগেডের একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়াতে তিনি প্রস্তুত। কখনও কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে সিবিআই পাঠানো নিয়ে তীব্র আক্রমণ করেছেন। কখনও আচম্বিত কটাক্ষে বলেছেন— ৫৬ ইঞ্চি ছাতি রয়েছে তো কী হয়েছে, সে তো রাবণেরও ছিল! কখনও চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন— পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের সবক’টি তৃণমূল পাবে।

এ দিনের সভার শেষ বক্তা ছিলেন অরবিন্দ কেজরীবাল। সারা দেশ থেকে আসা নেতাদের তিনি ধন্যবাদ জানালেন এ দিন। কিন্তু খুব স্পষ্ট করেই বললেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিশেষ ধন্যবাদ দিতে চান। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বাংলোয় ৪০ জন সিবিআই অফিসারকে পাঠিয়ে দেওয়া আসলে কলকাতা পুলিশ কমিশনারের উপরে আঘাত নয়, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের উপরে আঘাত, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত— মন্তব্য কেজরীবালের। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘সে দিন যদি কলকাতার পুলিশ কমিশনার গ্রেফতার হয়ে যেতেন, তা হলে গোটা দেশের সব আইপিএস-এর কাছে বার্তা চলে যেত— কোনও রাজ্য সরকারকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই, শুধু মোদী সরকারকে ভয় পাও।’’ কেজরীবাল বললেন, ‘‘সিবিআই অফিসারদের দৌড় করিয়ে,গাড়িতে ভরে যে ভাবে ফেরত পাঠালেন মমতা দিদি, তার জন্য তাঁকে বিশেষ ধন্যবাদ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।’’

কলকাতার সমাবেশের আয়োজক ছিলেন মমতা নিজে। সে সমাবেশের অতিথিরা মমতাকেই বিশেষ গুরুত্ব দেবেন নিজেদের ভাষণে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু দিল্লিতে আয়োজিত এক যৌথ সমাবেশ, আয়োজক আম আদমি পার্টি, হাজির বিরোধী শিবিরের রথী-মহারথীরা এবং প্রায় প্রত্যেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলে যাচ্ছেন যে, মোদী বিরোধী লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা এখন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য— এমন পরিস্থিতি কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে আগে কখনও তৈরি হয়নি। জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে অনেক দশক ধরে যাতায়াত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু বুধবার যন্তরমন্তরের মঞ্চ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে ভাবে স্বীকৃতিটা দিল, এর আগে সর্বভারতীয় স্তরের আর কোনও যৌথ মঞ্চ তাঁকে সে ভাবে মধ্যমণি করে তুলেছিল কি না, মনে করতে পারছেন না তৃণমূল নেতারাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন