Delhi Violence

‘ওরা এসে থাকবে কোথায়, কিছু তো রাখেনি’

পাকাপাকি ভাবে কি মুছল সব দাগ? সন্দেহ, অবিশ্বাস আর ঘৃণার? প্রশ্নটা রয়েই গেল।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২০ ০৩:৪৫
Share:

জ্বলে-পুড়ে গিয়েছে বাড়িঘর। —ফাইল চিত্র

ঝামা হয়ে যাওয়া বাড়ির সামনে ঠায় উবু হয়ে বসেছিলেন মহম্মদ খলিল। স্যাঁতসেঁতে আধো-অন্ধকার গলি। আবর্জনাময়ও বটে। গলির শেষ প্রান্তে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল গয়নার বাক্সের কারিগর খলিলের। তিরিশ বছরের পুরনো এই বাড়িই আজ তাঁর কাছে অচেনা। বাড়ি বলে অবশ্য কিছু নেই। পড়ে রয়েছে শুধু কাঠামোটা। আজ যার ভিতরে কখনও ঢুকছেন। বেরিয়ে এসে আবার বসে পড়ছেন রাস্তায়। আগের ভঙ্গিতেই।

Advertisement

মহম্মদ খলিলের দেখা মিলল মুস্তফাবাদের চমন পার্কে। উত্তরপ্রদেশ লাগোয়া ওই এলাকাটি ছিল উত্তর-পূর্ব দিল্লির গোষ্ঠী সংঘর্ষের অন্যতম স্নায়ুকেন্দ্র। সাম্প্রতিক সব রকমের হিংসার সাক্ষী এই এলাকা। যার উল্টো দিকেই শিব বিহার। রবিবার দুপুরের পর থেকেই শিব বিহার থেকে উড়ে আসতে শুরু করেছিল পাথর, পেট্রোল-বোমা। সন্ধ্যার পর থেকে পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে মুস্তফাবাদ। খলিল বলছেন, ‘‘বিবি-বাচ্চা নিয়ে রাতভর চোখের পাতা এক করতে পারিনি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভোরের আলো ফুটতেই হাঁটা লাগাই। সঙ্গে কিছুই নিতে পারিনি।’’ আজ সাত দিনের মাথায় ফিরে এসে দেখেন মাথা গোঁজার ঠাঁই বলে কিছু নেই। যেন পুড়ে গিয়েছে গোটা সংসারটাই। জমানো টাকা দিয়ে তিল তিল করে দোতলা তুলেছিলেন। তা এখন কার্যত শ্মশান। যা ছিল, হয় লুট হয়েছে, না-হলে পুড়ে ছাই।

চমন পার্কের খলিল, ব্রিজ পুরীর ইউনুস কিংবা খজুরী খাসের আখতার— সকলেরই অবস্থাই এক রকম। অন্যদের দেখাদেখি প্রতিবাদ হিসেবে বাড়িতে ‘নো এনআরসি-নো এনপিআর’ পোস্টার লাগিয়েছিলেন খজুরী খাসের বাসিন্দা আখতার। সেই ‘অপরাধে’ বাড়ি লুট করে জ্বালিয়ে দেওয়া তো হয়েইছে, ছাড় পায়নি আখতারের তিন বছরের ছেলের সাইকেলটিও। উন্মত্ত জনতার হাত থেকে বাঁচতে পরিবারের সকলকে নিয়ে বাড়ির লাগোয়া ছাদের পর ছাদ টপকে বড় রাস্তায় পৌঁছেছিলেন। সেখান থেকে সোজা গাজিয়াবাদে, এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তাই আখতারদের প্রাণটুকু বেঁচেছে। অনেকে তো তা-ও পারেননি। খজুরী খাসেই আগুনে দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন এক বৃদ্ধা। পালাতে পারেননি। আর একটু কান পাততেই শোনা গেল, পালানোর নানা কাহিনি। কেউ কার্নিশ টপকে। কেউ লাগোয়া ছাদ ডিঙিয়ে। শোনা গেল, সিঁড়ি জ্বলছে বলে দোতলা থেকে চাদর পাকিয়ে তাতে ঝুলেও নেমেছেন অনেকে।

Advertisement

গত রবিবার থেকে দিল্লিতে যে গোষ্ঠী সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল, আজ সাত দিনের মাথায় সেই উত্তেজনা নেই। সংঘর্ষের গোড়ার দিকের এলাকা ছেড়ে পালানোর ঘটনাও কমে গিয়েছে। উল্টে যারা খলিল বা আখতারের মতো পালিয়েছিলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে হলেও ফিরছেন। নিজেরা আসছেন ঠিকই, কিন্তু স্ত্রী-সন্তানদের ফেরানোর হিম্মত হয়নি। আখতারের কথায়, ‘‘এসে থাকবে কোথায়? কিছুই তো রাখেনি।’’ কত দিন অন্যত্র, অন্যের ভরসায় দিন কাটবে, তা ভেবেই কূলকিনারা করতে পারছেন না সব হারানো মানুষগুলি।

যদিও ক্ষতিপূরণের ভরসা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল। কিন্তু তাতে কি! কারওয়াল নগরের ছাইয়ে পরিণত হওয়া গাড়ি সার্ভিস সেন্টারের মালিক হরিন্দর সিংহ বলছেন, ‘‘ক্ষতিপূরণ চাইব কী দেখিয়ে! দোকানের নথি তো গিয়েছে, এমনকি কম্পিউটারে থাকা সব তথ্যও জ্বলে গিয়েছে।’’ একই বক্তব্য খলিলদেরও। কোনও রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল। বাড়ির দলিল-দস্তাবেজ সব এখন ছাই। খলিল বলেন, ‘‘সরকারের কাছে কী দেখিয়ে ক্ষতিপূরণ চাইব বলতে পারেন?’’

মৌজপুর-বাবরপুর বা জাফরাবাদ এলাকায় আজ দোকানপাট খুলছে। ফিরে এসেছে পরিচিত যানজটও। জাফরাবাদ এলাকায় আজ খোলা ছিল বেশ কয়েকটি স্কুল। কিন্তু এই চিত্র বাইরের। বড় রাস্তা থেকে একটু ভিতরে ঢুকলেই চিত্র অনেকটা আলাদা। খাজুরি খাস থেকে চমন পার্কের দিকে এগোতে বেড়েছে দমচাপা ভাব। আজও দিনভর অলি-গলিতে টহল মেরেছে আধা সেনা। একটু ভিড় বাড়লেই যারা লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে গিয়েছে ভিড়ের দিকে। কিছু পান-সিগারেটের দোকান, আধা শাটার নামানো মুদি ও ওষুধের দোকান ছাড়া খোলা নেই কিছুই। বসছে না বাজারও। বাড়ন্ত ডিম-দুধ কিংবা আনাজ। দাম বাড়তে শুরু করেছে নিত্য
প্রয়োজনীয় বস্তুর।

যত দিন পুলিশ-আধা সেনা আছে, নতুন করে ঝামেলার সম্ভাবনা কম। বজায় থাকবে আপাত শান্তি। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালও এলাকা ঘুরে বলেছেন, ‘‘যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। নিরাপত্তার গ্যারান্টি নিয়েছে সরকার।’’ কিন্তু পুলিশ-আধা সেনা সরে গেলে?

হিংসার দিল্লিতে আজ বিকেলে হঠাৎ বৃষ্টি নামল অসময়ে। জলের ধারায় হয়তো ধুয়ে গেল চাপ চাপ রক্তের দাগ। কিন্তু পাকাপাকি ভাবে কি মুছল সব দাগ? সন্দেহ, অবিশ্বাস আর ঘৃণার? প্রশ্নটা রয়েই গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন