টাকা বাতিলে সঙ্কটে জঙ্গিরা, বলছে পুলিশ

নোট বাতিলের ধাক্কায় বেসামাল জঙ্গি সংগঠনগুলি। নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়ে রাতারাতি কমে গিয়েছে তোলাবাজি ও অপহরণ। অসমেও একই অবস্থা। জঙ্গি সংগঠনগুলির লিঙ্কম্যান ও ওভারগ্রাউন্ড কর্মীদের দিকে নজর রাখছে পুলিশ।

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:১৭
Share:

নোট বাতিলের ধাক্কায় বেসামাল জঙ্গি সংগঠনগুলি। নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়ে রাতারাতি কমে গিয়েছে তোলাবাজি ও অপহরণ। অসমেও একই অবস্থা। জঙ্গি সংগঠনগুলির লিঙ্কম্যান ও ওভারগ্রাউন্ড কর্মীদের দিকে নজর রাখছে পুলিশ। টাকা ভাঙাতে গেলেই তাদের ধরা হবে। কিন্তু কয়েক দিন জঙ্গিদের টাকা চেনা পথে ব্যাঙ্কে যায়নি। উত্তর-পূর্বে জঙ্গি তাণ্ডব সব চেয়ে বেশি মেঘালয়ে। মুক্তিপণের জন্য জিএনএলএ, আসাক, এসিএনএলএর মতো সংগঠনগুলি অসমের ব্যবসায়ীদের অপহরণ করে। মুক্তিপণ আদায় থেকে শুরু করে তোলাবাজি, অস্ত্র কেনাবেচা সবই চলে নগদ ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোটে। জঙ্গিডেরার বরাবরই ১ হাজারের নোটের চাহিদা বেশি। কিন্তু আচমকা সে সব নোট বাতিল হওয়ায় বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে বিপাকে পড়েছে জঙ্গিরা।

Advertisement

মেঘালয়ের ডিজিপি এস বি সিংহ জানান, জঙ্গিরা কোন পথে টাকা সরানোর চেষ্টা করছে তা জানার জন্য কড়া নজর রাখা হচ্ছে। লিঙ্কম্যানদের উপরেও চলছে নজরদারি। ব্যাঙ্কে মোটা টাকা জমা দিতে গেলেই পুলিশ ও আয়কর কর্মীরা খোঁজখবর নেবেন। মেঘালয় পুলিশ সূত্রে খবর, জিএনএলএ সেনাধ্যক্ষ সোহন ডি শিরার কাছে থরে থরে নোট জলের ট্যাঙ্কে লুকোনো আছে। সেই নোটের পাহাড় এখন তার কাছে বোঝা। জমানো টাকার ব্যবস্থা করতে না পারার পাশাপাশি তোলা আদায়েও বাধা এসেছে। মানুষের হাতে টাকা নেই। তাই বাজার-ব্যবসা বন্ধ। যা ছিল জঙ্গিদের মূল টাকা তোলার উৎস। অপহরণ করেও লাভ নেই। কারণ, অপহৃতের পরিবার টাকা জোগাড় করতে পারবে না বা ১০০ বা ২০ টাকার বান্ডিল লুকিয়ে আনাও সম্ভব হবে না। অপহরণ ও তোলাবাজির জন্য কুখ্যাত অসমঘেঁষা দক্ষিণ গারো হিলের এসপি আনন্দ মিশ্র জানান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘোষণার পর থেকে জেলায় কোনও তোলাবাজি বা অপহরণ ঘটেনি। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে জঙ্গিরা ব্যবসায়ীদের উপরে চাপ দিয়ে পুরনো টাকা নিয়ে খুচরো দিতে বাধ্য করছে। সংঘর্ষবিরতিতে থাকা এএনভিসি-বি সংগঠনের নেতা বার্নার্ড মারাকের মতে, জমানো টাকা নষ্ট করে ফেলা ছাড়া জঙ্গিদের অন্য উপায় নেই।

এমনই এক ভিডিও এখন উত্তর-পূর্বের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ‘ভাইরাল’ হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে— বাক্সভরা ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট পুড়িয়ে চা ও শুয়োরের মাংস রান্না করে খাচ্ছে একটি নাগা জঙ্গি সংগঠনে সদস্যরা। নাগাল্যান্ডে তোলাবাজির বিরুদ্ধে লড়াই চালানো আকাউট সংগঠন ও পুলিশের মতে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় সেখানকার আমজনতার মতো জঙ্গিরাও বিপদে পড়েছে।

Advertisement

আকাউটের প্রচার সচিব মার লংকুমার জানান, ডিমাপুর ও কোহিমা বাদে নাগাল্যান্ডে এমনিতেই ব্যাঙ্কের শাখা বা এটিএম কম। সেখানকার মানুষ নগদ টাকা রাখেন। সব লেনদেন নগদে চলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানকার ব্যবসা, কেনাবেচা, বিভিন্ন সরকারি ও স্কুলের ফি জমা দেওয়া বন্ধ। নাগাল্যান্ডে চারটি বড় জঙ্গি সংগঠন মানুষের কাছ থেকে ব্যবসা ও বেতনের ২০ শতাংশ পর্যন্ত কর আদায় করে। এখন উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে জঙ্গিকর আদায়।

আকাউট ও অন্য সংগঠনগুলির মতে, নাগাল্যান্ডে এনএসসিএনের শাখাগুলি যে ভাবে সমান্তরাল সরকার চালায় তাতে পুলিশ, প্রশাসন, নেতা, ধর্মীয় নেতা, কিছু গির্জা, আন্তর্জাতিক সংগঠন ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ব্যবহার করে তারা অনেক টাকাই সাদা করার চেষ্টা চালাবে। পুলিশ জানায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে উত্তর-পূর্বে অস্ত্র কারবার, বন্যপ্রাণীর দেহাংশ এবং মাদক কারবারের ব্যবসা খানিকটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে। জঙ্গি সংগঠনগুলির নেতা ও সদস্যদের অ্যাকাউন্টে কড়া নজর রাখা হচ্ছে। বাইরের রাজ্যে টাকা পাঠানোর চেষ্টা হতে পারে। তাই সীমানায় চলছে কড়া নজরদারি। পুলিশের মতে, জঙ্গিদের কাছে থাকা টাকার পাহাড় পুড়িয়ে ফেলা ছাড়া গতি নেই।

অসমে জঙ্গি তোলাবাজির পরিমাণ অবশ্য অনেকটা কম। করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে মিজো, ব্রু জঙ্গি, তিনসুকিয়া, ডিব্রুগড়ে আলফা, মেঘালয় ঘেঁষা মানকাচর, গোয়ালপাড়ায় গারো জঙ্গিদের দাপট রয়েছে। কিন্তু তোলাবাজি কমেছে সর্বত্রই। পুলিশের মতে, জঙ্গিদের জমানো টাকার সিংহভাগ রয়েছে উজানি অসম, কার্বি আংলং, ডিমা হাসাও এবং বড়োভূমিতে। সেখান থেকে মোটা টাকা ব্যাঙ্ক জমা পড়ছে কি না, তার উপরে পুলিশের নজর রয়েছে।

রাঝয় পুলিশের ডিজি মুকেশ সহায় জানান, তোলাবাজি বা জঙ্গি সংগঠনগুলির উপরে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের কী প্রভাব পড়েছে তা এত তাড়াতাড়ি বলা যাবে না। তবে পুলিশ-প্রশাসন ও আয়কর দফতর সব দিকে কড়া নজর রাখছে।

এ দিকে মণিপুরেও জঙ্গি সংগঠনগুলিতে হাহাকার। পুলিশ সূত্রে খবর, জমানো টাকা কোনও উপায়ে বাইরের দেশে পাঠানো যায় কি না- তা নিয়ে খাপলাং বাহিনী ও আলফা স্বাধীনের সঙ্গেও তাদের জরুরি বৈঠক হয়েছে। থেমে গিয়েছে তোলাবাজি। জঙ্গিরা উল্টে পুরনো ৫০০-১ হাজার টাকার নোট নিয়ে কম পরিমাণে হলেও খুচরো টাকা দেওয়ার জন্য গ্রামবাসীদের হাতেপায়ে ধরছে। কিন্তু কোথায় টাকা!

এই পরিস্থিতিতে নগদ টাকার অভাবে আজ থেকে মণিপুরে সব সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সারা মণিপুর সংবাদপত্র প্রকাশক ও বিতরণকারী সংগঠন যৌথ বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ থাকবে।

উত্তর-পূর্ব বণিক সংগঠন ফাইনারের মধ্যে দেশের মধ্যে উত্তর-পূর্বে অংসগঠিত শিল্প-বাণিজ্য বেশি। তেমনই কম ব্যাঙ্কের শাখা ও এটিএম। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়েছে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে লেনদেন। ফাইনারের সভাপতি পবিত্র বুড়াগোঁহাই বলেন, “গত এক সপ্তাহে উত্তর-পূর্বের ব্যবসা ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। কালো টাকা রোখার জন্য বিপ্লব আনার আগে মানুষকে তৈরি হওয়ার সময় দেওয়া উচিত ছিল।’’ তাঁর বক্তব্য, পুরসভাগুলির উচিত সব ছোট ব্যবসায়ীর ব্যাঙ্ক অ্যাকউন্ট বাধ্যতামূলক করা। নির্মাণক্ষেত্রে ৪০-৫০ শতাংশ কাজ নগদ টাকায় হয়। তা থেমে গিয়েছে। হকার, ছোট দোকানদারদের

অবস্থা শোচনীয়। এই সিদ্ধান্ত ধাক্কা কতদূর যাবে তা আরও পরে বোঝা যাবে। কেন্দ্রকে সেই মতো ব্যবস্থাও নিতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement