সত্যিই কি কাশ্মীর নিয়ে ট্রাম্পকে মধ্যস্থতা করতে বলেছিলেন মোদী? শুরু হয়েছে কূটনৈতিক দোলাচল

ভারতে আজ ভোর থেকে বিষয়টি নিয়ে সর্বত্র এতটাই আলোড়ন পড়ে যায় যে সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই এ নিয়ে বিবৃতি তৈরি করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৯ ০২:০৩
Share:

ছবি: এএফপি এবং পিটিআই।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাশ্মীর মধ্যস্থতা সংক্রান্ত মন্তব্যের পরে এক বিচিত্র কূটনৈতিক দোলাচল তৈরি হল। এক দিকে ভারত এবং আমেরিকার ঘরোয়া রাজনৈতিক শিবিরে প্রতিক্রিয়া ও বাদানুবাদ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কূটনীতিকদের মধ্যে ট্রাম্পের এই মন্তব্য নিয়ে তৈরি হয়েছে কুয়াশা। দুই গোলার্ধেই উঠছে একাধিক প্রশ্ন। প্রথমত, সত্যিই কি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ট্রাম্পকে কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতা করতে বলেছিলেন? দ্বিতীয়ত, দু’জনের বাক্যালাপের সময় কোনও ভাষাগত ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল কি? তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, জেনে বুঝেই কি এমন অসত্য বললেন ট্রাম্প? সেটা বললেনই বা কেন?

Advertisement

এরই মধ্যে মার্কিন বিদেশ দফতর অবশ্য পরিস্থিতি সামলাতে আসরে নেমেছে। তাদের তরফে জানানো হয়েছে, কাশ্মীর ভারত-পাকিস্তানের ‘দ্বিপাক্ষিক’ বিষয়। আমেরিকা উপমহাদেশে উত্তেজনা কমাতে যে কোনও উদ্যোগকে সমর্থন করতে তৈরি। প্রেসিডেন্ট সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন। এই সমস্যা মেটাতে গেলে পাকিস্তানকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে কড়া পদক্ষেপ করতে হবে বলে মনে করে ওয়াশিং‌টন। কিন্তু পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এ দিনও স্পষ্ট জানিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক স্তরে এই সমস্যা মেটানো অসম্ভব। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যে ওয়াশিংটনেও বিতর্ক ও ধন্দ তৈরি হয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে ট্রাম্পের আর্থিক পরামর্শদাতা ল্যারি কাডলোর মন্তব্য থেকে। মোদী ট্রাম্পকে মধ্যস্থতা করতে বলেছিলেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে কাডলো বলেন, ‘‘এটা খুব দুর্বিনীত প্রশ্ন। প্রেসিডেন্ট মিথ্যে বলেন না। আমি এ নিয়ে কথা বলব না। নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন, বিদেশসচিব মাইক পম্পেয়ো বা প্রেসিডেন্ট নিজে চাইলে এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন।’’

ভারতে আজ ভোর থেকে বিষয়টি নিয়ে সর্বত্র এতটাই আলোড়ন পড়ে যায় যে সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই এ নিয়ে বিবৃতি তৈরি করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথমে রাজ্যসভা এবং তার পরে লোকসভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়ে দেন যে মোদী ট্রাম্পকে কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতার কথা কখনও বলেননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি সুনির্দিষ্ট ভাবে সংসদকে আশ্বস্ত করতে চাই যে এই ধরনের কোনও অনুরোধ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পক্ষ থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে যায়নি। আমি আবারও আমাদের ধারাবাহিক অবস্থানকেই স্পষ্ট করে দিতে চাইছি। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বকেয়া সমস্ত বিষয় নিয়ে একমাত্র দ্বিপাক্ষিক স্তরেই আলোচনা সম্ভব।’ তবে বিদেশমন্ত্রীর বিবৃতিতে সন্তুষ্ট নন বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী সংসদে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলুন।

Advertisement

কূটনীতিকদের মতে, কাশ্মীরে মধ্যস্থতা সংক্রান্ত অনুরোধ থেকে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ দমন প্রসঙ্গে চলে যাওয়ার একটা চেষ্টা দেখা গিয়েছে মার্কিন বিদেশ দফতরের তরফে। মোট তিন-চারটি বিষয়কে সামনে তুলে আনতে চাইছে তারা।

আমেরিকায় প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রণেন সেনের কথায়, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই আমেরিকা আমাদের বিদেশনীতির জটিলতার তারতম্য ও সূক্ষ তফাত বোঝে না। তবে এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয় কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।’’ তাঁর মতে, এর আগে গোটা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত পাকিস্তানি জঙ্গিদের নিশানা ছিল। তাই আমেরিকার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা করার সময়ে আলাদা করে কাশ্মীর প্রসঙ্গ তোলার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু গত চার-পাঁচ বছরে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠনগুলি শুধুমাত্র কাশ্মীরেই রক্তপাত ঘটাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী হয়তো জঙ্গি-দমন প্রসঙ্গে কাশ্মীরের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। সেটার ভুল ব্যাখ্যা করেছে হোয়াইট হাউস।

আরও একটি বিষয়ও কিন্তু উঠে আসছে কূটনীতিবিদদের আলোচনায়। সেটি হল আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ায় ক্রমশ কোণঠাসা করা হয়েছে নয়াদিল্লিকে। সূত্রের খবর, পাকিস্তান আমেরিকাকে একটি প্রতিদানের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। সেটি আফগানিস্তানে শান্তি ফেরানো সংক্রান্ত। প্রস্তাবটি হল কাবুলে তালিবানের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে আমেরিকাকে সব সাহায্য করতে রাজি ইমরান সরকার। কিন্তু তাদের দাবি, বিনিময়ে কাশ্মীর নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে হবে আমেরিকাকে। এই কারণেই আগ বাড়িয়ে ট্রাম্প এমন একটি মন্তব্য করলেন কি না – প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও।

ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পিছনে ‘কিছু আদায়ের’ তথা চাপের কূটনীতির ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন কূটনীতিকদের অনেকে। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টকে যতই জড়িয়ে ধরুন মোদী, প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতে রাজি না হওয়া থেকে শুরু করে শুল্ক, ইরান নিষেধাজ্ঞা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারতের প্রতি যথেষ্ট কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন ট্রাম্প। প্রজাতন্ত্র দিবসের আমন্ত্রণ তিনি ফিরিয়েছেন বেশ সময় নিয়ে এবং এটা বুঝিয়ে যে তাঁর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। প্রতিরক্ষা এবং বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠক পূর্বঘোষিত সময়ে করা হয়নি, একই কারণ দেখিয়ে। পরে সেই বৈঠক হয়েছে বটে, কিন্তু তার আগে ভারত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং প্রযুক্তি সহযোগিতার দু’টি চুক্তি সই করেছে, যাতে আমেরিকার সুবিধেই বেশি বলে কূটনীতিকদের একাংশের মত। ফলে নয়াদিল্লির আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল বলে তাঁরা মনে করছেন। কূটনীতিকদের একাংশ এ-ও মনে করিয়েছেন, যে কাতারকে জঙ্গিবাদের উৎস বলে চিহ্নিত করেছিলেন ট্রাম্প, সেই কাতার পরে আমেরিকার থেকে অস্ত্র কেনার জন্য বিরাট অঙ্কের চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন