নগদ বিদায় সম্ভব নয়, মত অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির

মুঠোয় ধরা মোবাইলকে ব্যাঙ্ক বানানোর ডাক দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। ফেরি করছেন ‘ক্যাশলেস ইকনমি’র (নগদহীন অর্থনীতি) স্বপ্ন। সেখানে তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি মনে করছেন, ডিজিটাল লেনদেন নগদের বিকল্প নয়। বরং সমান্তরাল ব্যবস্থা! অর্থাৎ, কার্ড-ই ওয়ালেট-অ্যাপের হাত ধরে নোট বিদায় এখনই সম্ভব নয় বলে মেনে নিচ্ছেন তিনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:০৯
Share:

মুঠোয় ধরা মোবাইলকে ব্যাঙ্ক বানানোর ডাক দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। ফেরি করছেন ‘ক্যাশলেস ইকনমি’র (নগদহীন অর্থনীতি) স্বপ্ন। সেখানে তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি মনে করছেন, ডিজিটাল লেনদেন নগদের বিকল্প নয়। বরং সমান্তরাল ব্যবস্থা! অর্থাৎ, কার্ড-ই ওয়ালেট-অ্যাপের হাত ধরে নোট বিদায় এখনই সম্ভব নয় বলে মেনে নিচ্ছেন তিনি।

Advertisement

বৃহস্পতিবার জেটলি বলেন, ‘‘ডিজিটাল লেনদেন নগদের বিকল্প নয়। বরং সমান্তরাল ব্যবস্থা। কোনও অর্থনীতিই পুরোপুরি নগদহীন হতে পারে না। ক্যাশলেস বা নগদহীন অর্থনীতিই আসলে লেস ক্যাশ বা কম নগদের অর্থনীতি।’’

কালো টাকার পাহাড় ধরার চাঁদমারি বদলে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। ঘরে-বাইরে চাপের মুখে সরে যাচ্ছে নগদহীন ডিজিটাল অর্থনীতির ‘গোলপোস্ট’ও। সেই পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে রাজনৈতিক মহল। প্রশ্ন উঠছে, শুধু সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতেই কি এমন বললেন অর্থমন্ত্রী? না কি জেনেবুঝেই কিছুটা দূরত্ব রাখলেন ডিজিটাল লেনদেন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একবগ্গা অবস্থান থেকে?

Advertisement

৮ নভেম্বর নোট বাতিলের ঘোষণার সময় মোদীর দাবি ছিল, এতে মাথায় হাত পড়বে কালো টাকা আর জাল নোটের কারবারিদের। বন্ধ হবে সন্ত্রাসে টাকার জোগানও। কিন্তু হাত পুড়িয়ে সরকার বুঝেছে, কালো টাকা বা জাল নোট জব্দ করার শক্তি নোট নাকচের অস্ত্রে নেই। তাই মুখ রাখতে জোর দেওয়া হচ্ছে নগদহীন ডিজিটাল লেনদেনে। কিন্তু সেই ‘ক্যাশলেস ইকনমি’র (নগদহীন অর্থনীতি) স্বপ্নও দ্রুত ফিকে হয়ে এসে ঠেকছে ‘লেস ক্যাশ ইকনমি’তে (কম নগদের অর্থনীতি)। আর নগদ যে তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ থাকছে, তা এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন জেটলি।

তবে এই ডিজিটাল লেনদেনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে এ দিন লটারির গাজর ঝুলিয়েছে মোদী সরকার। তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৩৪০ কোটি টাকা! যদিও ওই টাকা ইন্টারনেট পরিকাঠামোয় খরচ করলে তা বেশি কাজের হতো কি না, শুরুতেই সেই প্রশ্ন তুলেছে শিল্পমহল।

ব্যাঙ্ক আর এটিএম থেকে খালি হাতে ফিরতে-ফিরতে বিরক্ত সাধারণ মানুষ যে ডিজিটাল-বুলিতে ভুলছেন না, প্রতিদিন তা স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ। বিজেপির জনপ্রতিনিধিরা মুখে স্বীকার না-করলেও সেই ক্ষোভের আঁচ পেয়েছেন। তা নিয়ে সরব হয়েছে আরএসএস এবং সঙ্ঘ-পরিবারের সংগঠনগুলি। তাদের প্রশ্ন, ডিজিটাল লেনদেনের অবাস্তব স্বপ্ন বেচে লাভ কী? বুধবার সঙ্ঘ-পরিবার সমর্থিত ক্ষুদ্র শিল্পের সংগঠন লঘু উদ্যোগ ভারতীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল। সেখানেও ক্ষোভের আঁচ পান তিনি। তাই তার পরে অর্থ মন্ত্রকের উপদেষ্টা কমিটিতে জেটলির এই মন্তব্য মূলত ক্ষোভে জল ঢালার চেষ্টা বলে অনেক বিজেপি নেতার ধারণা। নইলে খোদ প্রধানমন্ত্রী যেখানে মোবাইলকে ব্যাঙ্ক বানানোর ডাক দিচ্ছেন, সেখানে অর্থমন্ত্রী নগদের গুণ গাইবেন কেন?

নগদের আকালের এই বাজারে আমজনতার ক্ষোভের আগুনে জল ঢালতে দ্বিমুখী কৌশল নিচ্ছে কেন্দ্র— প্রথমত, শুক্রবার চলতি অধিবেশনের শেষ দিন সকালে বিজেপি সাংসদদের সামনে নোট বাতিল নিয়ে নিজের বক্তব্য জানাবেন প্রধানমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, রাজনৈতিক ভাবে এ বিষয়ে বিরোধীদের আক্রমণের মোকাবিলা কী ভাবে করতে হবে, সেই রূপরেখাই সেখানে তুলে ধরা হবে। মোদী বলবেন, কী ভাবে ডিজিটাল লেনদেনের সুফল তুলে ধরতে হবে সাধারণ মানুষের সামনে। বিশেষত উত্তরপ্রদেশে ব্যালটের লড়াইয়ের আগে যাতে জনসমর্থনে চিড় না ধরে।

আর দ্বিতীয় তাসটি এ দিন সামনে এনেছেন নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্ত। ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহ দিতে লটারি মারফত পুরস্কারের ঘোষণা করেছে মোদী সরকার। কান্ত দাবি করেছেন, এ হল ‘বড়দিনের উপহার’। পরে টুইট করে একই কথা বলেছেন মোদীও।

কিন্তু বিরোধীরা বলছেন, এ হল নোট বাতিলের জেরে চূড়ান্ত ভোগান্তি সহ্য করার ক্ষতে সস্তা মলম।

পেট্রোল পাম্পে তেল কেনা থেকে নতুন বিমার প্রিমিয়াম, রেলের মান্থলি টিকিট থেকে জাতীয় সড়কে টোল মেটানো— সব জায়গায় নোট ছেড়ে কার্ড-অ্যাপ-ই ওয়ালেটের হাত ধরলে কী কী সুবিধা মিলবে, ৮ ডিসেম্বর তার এগারো দফা ফিরিস্তি দিয়েছিলেন জেটলি। বিরোধীদের কটাক্ষ, তাতে চিঁড়ে ভিজবে না আঁচ করেই কি তড়িঘড়ি লটারির ঘোষণা?

কেন্দ্রের ঘোষণা অনুযায়ী, যাঁরা ডিজিটাল মাধ্যমে কেনাবেচা করছেন, তাঁদের জন্য বড়দিন থেকে শুরু হবে লটারি। চলবে ১৪ এপ্রিল (বাবাসাহেব অম্বেডকরের জন্মদিন) পর্যন্ত। প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে পুরস্কার ঘোষণা হবে। শেষ দিনে ‘মেগা ড্র’। প্রথম পুরস্কারের মূল্য এক কোটি টাকা! শুধু ক্রেতা নন, ব্যবসায়ীরাও পুরস্কার পাবেন। কান্তের দাবি, ‘‘৩৪০ কোটি টাকার এই প্রকল্প শুধুমাত্র ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহ দেওয়ার জন্য।’’ যদিও ৮ নভেম্বর নোট বাতিলের ঘোষণার সময় এই লক্ষ্যের কথা সে ভাবে শোনা যায়নি।

এ দিন সংবাদমাধ্যমের সামনে কান্ত বলছিলেন, এই ধাক্কায় শুধু ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডে আটকে না থেকে দেশে একবারে অনেক কদম এগিয়ে যাবে ডিজিটাল লেনদেন। সে কথা মাথায় রেখেই জানানো হয়েছে, রুপে কার্ড, ইউপিআই, ইউএসএসডি ও আধার সংখ্যার মাধ্যমে লেনদেনে লটারিতে পুরস্কার মিলবে। এর মধ্যে আর্থিক ভাবে তুলনায় পিছিয়ে থাকা অনেকে রুপে কার্ড ব্যবহার করেন। আর বাকিগুলি দিয়ে কেনাকাটা বা টাকা লেনদেন করা যায় মোবাইলে নেট সংযোগ থাকলেই।

কিন্তু বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, যে দেশে এখনও অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষের হাতে স্মার্ট-ফোন নেই, নেট সংযোগ পৌঁছয়নি বেশিরভাগ ঘর বা মোবাইলে, সেখানে রাতারাতি এমন ডিজিটাল অর্থনীতির স্বপ্ন কেন্দ্র দেখে কী ভাবে? সেই পরিকাঠামো কোথায়? এমনকী এই প্রশ্ন তুলছে খোদ সঙ্ঘই।

লটারি প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা রণদীপ সূর্যেওয়ালা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘এটা কি ছোটদের জন্মদিনের পার্টি?’’ একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্ণধারের মন্তব্য, ‘‘৩৪০ কোটি টাকা যদি ইন্টারনেট সংযোগ বাড়াতে খরচ হত, তা হলে কাজের কাজ হতে পারত।’’

কেন্দ্রের দাবি, মূলত গ্রাম, মফসস্‌লের মানুষকে ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহ দিতেই এই লটারি। সেই কারণে ৫০ থেকে ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত লেনদেনই এর জন্য বিবেচ্য।

কিন্তু প্রশ্ন হল, আগে অঙ্ক না-শিখিয়ে তা ঠিক করার জন্য শিকেয় চকোলেট তুলে রেখে লাভ কী?

ডিজিটালে প্রাপ্তিযোগ

লাকি গ্রাহক যোজনা

• ১০০ দিন ধরে ১৫ হাজার ক্রেতার জন্য রোজ ১০০০ টাকার পুরস্কার

• সাপ্তাহিক পুরস্কার ১ লক্ষ টাকা, ১০ হাজার ও ৫ হাজার টাকা ডিজি-ধন ব্যাপার যোজনা

• ব্যবসায়ীদের জন্য সাপ্তাহিক পুরস্কার ৫০ হাজার, ৫ হাজার ও আড়াই হাজার টাকা অম্বেডকর জয়ন্তী মেগা ড্র

• ৮ নভেম্বর থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত যাবতীয় লেনদেনে। ড্র: ১৪ এপ্রিল

• ক্রেতাদের জন্য পুরস্কার ১ কোটি, ৫০ লক্ষ, ২৫ লক্ষ টাকা

• ব্যবসায়ীদের জন্য ৫০ লক্ষ, ২৫ লক্ষ ও ১২ লক্ষ টাকা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন