LPG Subsidy

গ্যাসের ভর্তুকি কেউ পাচ্ছেন, কেউ পাচ্ছেন না! রহস্যটা কোথায়?

সিআইআই-এর গত ২৭ তারিখের এক সেমিনারে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিপদ দাস বলেছেন— সরাসরি ভর্তুকিই একমাত্র রাস্তা।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২০ ১৭:৪৫
Share:

ব্যাঙ্কে গ্রাহকদের ভিড়।

বাড়িতে সকাল বিকেল আয়া। আর একটি রান্নার লোক। বৃদ্ধার ভরসা স্বামীর কল্যাণে মাস গেলে আসা পারিবারিক পেনশন আর অবসরপ্রাপ্ত পুত্রের সুদ বাবদ আয়। কাজের মানুষগুলির প্রত্যেকেরই জনধন অ্যাকাউন্ট আছে, কিন্তু কবে তার শেষ ব্যবহার করেছেন তাঁরা কেউ খবর রাখেন না। বৃদ্ধাও জানেন না তাঁর অ্যাকাউন্টে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি ঢোকে কিনা। পুত্র সংশয়ে। তবে তাঁর ধারনা, বেশ কিছু দিন ধরেই তাঁর মায়ের খাতায় গ্যাস বাবদ ভর্তুকি ঢোকে না।

Advertisement

কিন্তু দেশের নীতি নির্ধারকরা মতি স্থির করে ফেলেছেন যে, আগামীতে সব ভর্তুকিই দেওয়া হবে সরাসরি। সিআইআই-এর গত ২৭ তারিখের এক সেমিনারে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিপদ দাস বলেছেন— সরাসরি ভর্তুকিই একমাত্র রাস্তা। আর কয়েক সপ্তাহ আগে বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থার সংস্কারেও কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে, প্রতি রাজ্যে একাধিক বিদ্যুৎবণ্টন সংস্থা থাকবে। রাজ্য সরকার চাইলে গ্রাহকদের সরাসরি ভর্তুকি দিতে পারে।

হ্যাঁ, মানতেই হবে যে অর্থিনীতির তত্ত্ব বলে— সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে সরাসরি ভর্তুকিই বাজারের নিয়মে সুবিধা বণ্টনের সব থেকে ভাল পথ। কিন্তু সব কিছু কি ঠিকঠাক আছে? জুলাই মাসের ৯ তারিখে আনন্দবাজারে ‘গ্যাসের দাম বাড়লেও ফের এ মাসে থমকাল ভর্তুকি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখছি— সিলিন্ডার পিছু গ্যাসের দাম বাড়লেও, অনুপাতে কমছে ভর্তুকি। কিন্তু এই কমার খবর আমি আপনি জানি না। ওই একই প্রতিবেদনে অভিযোগ— কিছু গ্রাহকের ব্যাঙ্কে ভর্তুকি ঢুকলেও, বহু গ্রাহকই ওই ভর্তুকি পাননি। যাঁরা পাননি তাঁরা জানেনও না ওই ভর্তুকির টাকা কেন তাঁরা পাননি। এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকেও তাঁদের কিছু জানানো হয়নি।

Advertisement

দেশে জনধন অ্যাকাউন্ট আছে ৩৭ কোটি ৮৭ লক্ষ। তার মধ্যে ৮ কোটি অ্যাকাউন্ট অব্যবহৃত, ফলে অকেজো। ফাইল চিত্র।

২০১৬ সালে, গ্রাহকের ১০ লক্ষ টাকার উপর বার্ষিক আয় হলে রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এবং এটা যে সঠিক সিদ্ধান্ত তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ২০১৯ সালে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ৫ লক্ষ টাকার উপর আয় হলে আর ভর্তুকি না দেওয়ার সরকারি ভাবনাচিন্তার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কি না, তা কিন্তু জানা নেই।

তা হলে? সমস্যার জায়গাটা আরও বড়। অভিযোগ,সত্যিই যাঁদের এই ভর্তুকি প্রয়োজন, তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আগে সেই ভর্তুকি ঢুকলেও, এখন আয়ের সীমার নীচে থাকা অনেকেই তাঁদের প্রাপ্য পাচ্ছেন না। অর্থাৎ স্বচ্ছতার একটা অভাব থেকেই গিয়েছে। ২০১৯ সালে ৩৭ হাজার কোটি টাকার মতো পেট্রোলিয়ম ক্ষেত্রে ভর্তুকির চাপ ছিল কোষাগারের উপর। কিন্তু সরকার এই টাকা দিতে পারবে না তা কিন্তু কখনই বলেনি।

মেনে নেওয়া যাক ভর্তুকির এই সব সংবাদ নেহাতই ভুল। ধরে নেওয়া যাক সরাসরি ভর্তুকি দেওয়া হবেই। কিন্তু কী ভাবে? তার জন্য তো প্রাপকের অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, তাঁকে তা ব্যবহার করতেও জানতে হবে! আগে দেখে নেওয়া যাক ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার নিয়ে কয়েকটি তথ্য।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যে দেখা যাচ্ছে— জনধন অ্যাকাউন্ট আছে ৩৭ কোটি ৮৭ লক্ষ। তার মধ্যে ৮ কোটি অ্যাকাউন্ট অব্যবহৃতের তকমা পেয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়মে নাকি দু’বছর ধরে কোনও অ্যাকউন্টে লেনদেন না হলে, তা অব্যবহৃতের তকমা পায়। তার মানে আট কোটি মানুষ অ্যাকাউন্ট খুলেও ব্যবহার করেন না!

দেশের একটা বড় সংখ্যক মানুষ সই করতে পারলেও, কোথায় সই করছেন তা বুঝে উঠতে পারেন না। ফাইল চিত্র।

এঁরা তো যেখানে ব্যাঙ্ক আছে সেখানে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভিন্ন কারণে তা ব্যবহার করছেন না। কেন? তার উত্তর কিন্তু স্পষ্ট নয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরই সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ৫ লক্ষ ৯৭ হাজার ১৫৫টি গ্রামে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছিয়েছে। ২০১১ সালের সেনসাস বলছে, ভারতে মোট গ্রামের সংখ্যা ৬ লক্ষ ৪৯ হাজার ৪৮১টি। অর্থাৎ, ৫২ হাজারের উপর গ্রামে এখনও ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছিয়ে উঠতেই পারেনি। বিশ্বব্যাঙ্কের গ্লোবাল ফিনডেক্স সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে ১৯ কোটি মানুষ ব্যাঙ্কিং পরিষেবার বাইরে ছিলেন ২০১৭ সালে।

ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ঘরের পাশে থাকলেই যে সবাই তা ব্যবহার করতে পারবেন তাও নয়। একটা বড় সংখ্যক মানুষই সই করতে পারলেও, কোথায় সই করছেন তা বুঝে উঠতে পারেন না। প্রায় ২৮ কোটি মানুষ আমাদের দেশে নিরক্ষর। তাঁদের কাছে ব্যাঙ্কের খাতা কেন, ব্যাঙ্কের শাখায় ঢোকাটাই একটা বড় সাহসের পরিচয়।

তা হলে? সরাসরি ভর্তুকি সব থেকে সেরা উপায়। কিন্তু দিতে গেলে যে পরিকাঠামো গড়ে তোলা দরকার, সে দিকে যতটা নজর দেওয়া দরকার তা না দিয়ে তার থেকেও আমরা তো বেশি ব্যস্ত রাজনৈতিক আকচাআকচিতে। যে দেশে ২৮ কোটি নিরক্ষর, আর তার বহুগুণ মানুষ ‘ব্যবহারিক নিরক্ষর’, সই করার বাইরে কোনও লেখা পড়ে তার মানে উদ্ধারে অক্ষম, সে দেশে সরাসরি ভর্তুকি ব্যবস্থা কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ।

অর্থনীতির তত্ত্ব একে সমর্থন করলেও, তার সফল প্রয়োগের জন্য যে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও সহমর্মিতার প্রয়োজন তার অভাব কিন্তু সরকারী ব্যবহারের প্রতিটি পদক্ষেপে। গ্যাসের ভর্তুকি তো একটি উদাহরণ মাত্র। অন্য ক্ষেত্রগুলিতেও সরকারের পদক্ষেপ নাগরিকের প্রতি কোষাগারের আর্থিক দায় ঝেড়ে ফেলার রাস্তার দিকই নির্দেশ করছে না তো এই নীতি পরিবর্তন? এই সংশয় কিন্তু ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না মন থেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন