মারতে হবে এক ঢিলে অনেক পাখি। এক রকম নিঃশব্দে ‘অপারেশন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব’ করে সেই কাজটিই রাতারাতি সেরে ফেললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
এক দিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের অপছন্দের লোক এল সি গয়ালকে স্বরাষ্ট্রসচিব পদ থেকে সরানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেই পদে বসানো হল অরুণ জেটলির ঘনিষ্ঠ আমলাকে। ফলে মন্ত্রকের শীর্ষ পদে নিজের পছন্দের আমলাকে বসানোর ব্যাপারে রাজনাথের ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে গেল! অন্য দিকে, ওই একই দিনে রাজনাথ-ঘনিষ্ঠ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক অতিরিক্ত সচিব অনন্ত কুমার সিংহকে বদলি করা হল পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকে। রাজনাথের ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে এই অনন্তই একাধিক বার গয়ালের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। মন্ত্রকের দুই শীর্ষ কর্তার এই বাদানুবাদে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন মোদী। দু’পক্ষকেই এক সঙ্গে বদলি করে মোদী ভারসাম্যের রাজনীতির বার্তা দিলেও শীর্ষ আমলাদের অনেকেরই ধারণা, অনন্তকে সরিয়ে আসলে পরিকল্পনা করেই রাজনাথের ডানা আরও ছাঁটা হল। আমলাদের নিঃশর্ত আনুগত্য পাওয়ার প্রশ্নে মন্ত্রকে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
রাজনাথ মন্ত্রকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যে দু’জনকে স্বরাষ্ট্রসচিব হিসেবে পেয়েছেন (অনিল গোস্বামী ও এল সি গয়াল), তাঁরা কেউই তাঁর বিশ্বাসভাজন ছিলেন না। এ বারে জেটলি-ঘনিষ্ঠ যে আমলা স্বরাষ্ট্রসচিব হলেন, সেই রাজীব মহর্ষির সঙ্গে রাজনাথের সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে, এমনটা আশা করছেন না খোদ মন্ত্রক-কর্তারাই।
মাস ছয়েক আগে দায়িত্ব নেওয়া গয়াল শুরু থেকেই রাজনাথের সঙ্গে মতান্তরে জড়ান। একাধিক ক্ষেত্রে মন্ত্রীর ইচ্ছাকেও গয়াল নিয়ম দেখিয়ে আটকে রাখা বা খারিজ করে দিতেন বলে দীর্ঘ দিনই সরব রাজনাথ শিবির। শুধু রাজনাথ নন, নাগা শান্তি চুক্তি প্রশ্নে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গেও মতান্তরে জড়ান গয়াল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের খবর, শুরু থেকেই রাজনাথ ও গয়ালের মতানৈক্য ভাল ভাবে নেননি মোদী। নাগা প্রশ্নে গয়ালের আচরণ তাঁর বিদায় নিশ্চিত করে।
কী বিষয়ে মতান্তর ঘটেছিল রাজনাথ ও গয়ালের? সূত্র বলছে, নিয়মের দোহাই দিয়ে একাধিক বিষয়ে মন্ত্রীর নির্দেশ এড়িয়ে গিয়েছেন গয়াল। প্রথমত, দিল্লির একটি হোটেলের লিজের অঙ্কে বড়মাপের গরমিল ধরা পড়ে। বিষয়টি নিয়ে রাজনাথ সিবিআইকে দিয়ে দ্রুত তদন্ত করার পক্ষে ছিলেন। অতিরিক্ত সচিব অনন্ত কুমার মন্ত্রীর ইচ্ছে মতো সেই সুপারিশ করলেও গয়াল তদন্তের প্রশ্নে সমস্ত নিয়ম মেনে চলার পক্ষপাতী ছিলেন। রাজনাথ শিবিরের বক্তব্য ছিল, এতে তদন্তের কাজে দেরি হবে। শেষ পর্যন্ত গয়াল যে দিন সরে যান, সে দিন সিবিআইকে দিয়ে ওই তদন্তের বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত আসে! দ্বিতীয়ত, আমলা বদলি নিয়েও রাজনাথ শিবিরের সঙ্গে সমস্যার জড়িয়ে পড়েন গয়াল। তামিলনাড়ু ক্যাডারের এক মহিলা আইপিএস দিল্লিতে বদলি হলেও তাঁকে ছাড়তে প্রথমে অসম্মতি ও পরে সাসপেন্ড করে জয়ললিতা সরকার। এ ক্ষেত্রে গয়াল ওই বদলির পক্ষে সওয়াল করলেও রাজনাথ-শিবিরের যুক্তি ছিল, এই ধরনের ঘটনা আখেরে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। রাজনাথ শিবির চেয়েছিল, ওই মহিলা আমলা তামিলনাড়ু ক্যাডারে ফিরে যান। যা মানতে রাজি হননি গয়াল। তৃতীয়ত, আইএএস আমলাদের জয়েন্ট ক্যাডার নিয়মাবলী রাজনাথ নতুন করে খতিয়ে দেখার পক্ষপাতী হলেও তা খারিজ করে দেন গয়াল।
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সঙ্গেও বিতর্কে জড়ান গয়াল। গত মাসে নাগা শান্তি চুক্তি সই করে সরকার একে নিজেদের বড় সাফল্য হিসেবে তুলে ধরে প্রচারে নামলেও তাল কাটে গয়ালের কথায়। তাঁর বক্তব্য ছিল, এ বিষয়ে তাঁর বা তাঁর মন্ত্রকের কিছু জানা নেই! সূত্রের খবর, এর পরেই গয়াল-বিদায়ের প্রক্রিয়া শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়।
গত সোমবার সরকারি ভাবে গয়ালকে সরানোর কথা ঘোষণা করা হলেও তার দু’দিন আগে, অর্থাৎ শনিবারই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী। সে দিনই ঠিক হয় কেন্দ্রের নতুন স্বরাষ্ট্রসচিব হবেন রাজীব মহর্ষি। জেটলি ঘনিষ্ঠ ওই আমলার গত সোমবারই অর্থ ও অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রকের সচিব পদ থেকে অবসর নেওয়ার কথা ছিল। সে দিনই তাঁকে পুনরায় বহাল করা হয়। শনিবার ওই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয় রাজনাথকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, ওই পদে পছন্দের আমলাকে বসানোর ইচ্ছে ছিল রাজনাথের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘রাজীবের নাম চূড়ান্ত হয়েছে শুনে রাজনাথ জানতে চান, ওই পদের জন্য আর কাকে কাকে বাছাই করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় তাঁকে জানায়, ওই পদের জন্য একমাত্র রাজীব মহর্ষির নামই বিবেচিত হয়েছিল এবং প্রধানমন্ত্রী নিজে সেই নাম মঞ্জুর করেছেন।’’
বলা বাহুল্য, এর পরে রাজনাথের আর কিছু বলার ছিল না। নিজের মন্ত্রকে অপছন্দের ‘রাজীব-বড়ি’ গিলতে বাধ্য হন নিঃসঙ্গ রাজনাথ!