স্টেথোস্কোপে প্রজাপতি-ফাঁদ কেন

ডাক্তারে-ডাক্তারে, অন্তত চিকিৎসক পরিবারের ছেলেমেয়ের বিয়ে ডাক্তার পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার একটি সর্বভারতীয় উদ্যোগের জেরে এই প্রশ্ন জোরদার হয়ে উঠেছে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:০১
Share:

প্রজাপতি ফাঁদ।

তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত ভারত কি পিছনে হাঁটতে শুরু করেছে? ডাক্তারে-ডাক্তারে, অন্তত চিকিৎসক পরিবারের ছেলেমেয়ের বিয়ে ডাক্তার পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার একটি সর্বভারতীয় উদ্যোগের জেরে এই প্রশ্ন জোরদার হয়ে উঠেছে।

Advertisement

উদ্যোগটা শুরু করেছে দেশের সর্ববৃহৎ চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বা আইএমএ। পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য একেবারে নিজস্ব সাইট খোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তারা!

কয়েক বছর আগে দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের পিএইচডি ডিগ্রিধারী এক ছাত্র পেশা-ভিত্তিক পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন সাইট খুলেছিলেন। সেখানে বিশেষ করে আইআইটি এবং আইআইএম পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। কয়েক বছর আগে কেরলে পাত্রপাত্রীর সাইট খোলে ডিওয়াইএফ। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, ধর্মনিরপেক্ষ বিয়েতে উৎসাহ দান।

Advertisement

কিন্তু যাঁদের জীবন মানুষের সেবায় উৎসর্গিত, সেই ডাক্তারদের এই পেশাগত কৌলীন্য রক্ষার তাগিদ বিস্ময় ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। রুচিরা ঘোষের মতো সমাজতত্ত্ববিদের প্রশ্ন, ‘‘তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত পেশাদারদের মধ্যে এ আবার কী অদ্ভুত সামাজিক কৌলীন্য রক্ষার চেষ্টা? ডাক্তার বলে ডাক্তার পাত্র বা পাত্রীকেই বিয়ে করতে হবে! ডাক্তারেরা কি অন্যান্য পেশার লোকজনকে নিজেদের সমকক্ষ মনে করছেন না? অন্যান্য পেশার মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক গড়লে কি তাঁদের মানসম্মান চলে যাচ্ছে?’’ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, প্রাচীন ভারতে বর্ণাশ্রম ছিল পেশা-ভিত্তিক। নিজের গোষ্ঠীর ভিতরেই বহুলাংশে সীমাবদ্ধ ছিল চার বর্ণের মেলামেশা, আত্মীয়তা। যুগ পাল্টেছে। তা সত্ত্বেও আইএমএ কেন কৌলীন্য প্রথা কায়েম করতে চাইছে, তার জবাব মিলছে না।

কী স্থির করেছে আইএমএ?

৩-৪ ফেব্রুয়ারি তিরুঅনন্তপুরমে আইএমএ-র সব রাজ্য শাখার বৈঠক ছিল। সেখানে ঠিক হয়েছে, সংগঠনের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি চিকিৎসক অশোক আধাও-এর নেতৃত্বে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন সাইট চালু হবে আইএমএ-র নিজস্ব ওয়েবসাইটে। সংগঠনের জাতীয় আর আঞ্চলিক সব পত্রপত্রিকাতেও সেই বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা হবে। সংগঠনের সাম্মানিক সাধারণ সম্পাদক রমেন্দ্রনাথ টন্ডনের ব্যাখ্যা, ‘‘প্রায় তিন লক্ষ চিকিৎসক আমাদের সংগঠনের সদস্য। তাঁদের মধ্যে অবিবাহিত-অবিবাহিতা আছেন অনেকে। তাঁরা পাত্র বা পাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। চিকিৎসক বাবা-মায়েরা তাঁদের অবিবাহিত ছেলে বা মেয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়ার সুযোগ পাবেন। চিকিৎসক পাত্র বা পাত্রী মিলবে সহজেই।’’

সংগঠনের সদ্য-প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি কৃষ্ণকুমার অগ্রবালের আরও খোলাখুলি বক্তব্য, চিকিৎসকদের অনেকেই নিজেদের পেশার পাত্র বা পাত্রীকে বিয়ে করতে চান। কোনও কোনও চিকিৎসক চান, তাঁর জীবনসঙ্গী ডাক্তার না-হোন, তিনি যেন চিকিৎসক-পরিবার থেকে আসেন। ‘‘এই ধরনের প্রত্যাশায় তো কোনও দোষ নেই। আইএমএ-র গঠনতন্ত্র সব সময়েই সদস্যদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চায়। তাই পাত্রপাত্রী সাইটের এই পরিকল্পনা করা হয়েছে,’’ বলছেন কৃষ্ণকুমার।

আইএমএ-কর্তাদের যুক্তি, অনেকে তো বিয়ের কুণ্ডলী মেলান, আইএমএ না-হয় চিকিৎসকের সঙ্গে চিকিৎসককে মেলাল। আপত্তি কী?

ডাক্তারদের কল্যাণকাজের সঙ্গে এই উদ্যোগকে যুক্ত করার চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। আইএমএ-র পাত্রপাত্রী সাইট সম্পর্কে সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার রাজ্য সম্পাদক শান্তনু সেন বলছেন, ‘‘ডাক্তারে-ডাক্তারে বিয়ে হলে বোঝাপড়া পোক্ত হবে। পরিবারে শান্তি আসবে। ডাক্তারেরা ঠান্ডা মাথায় রোগী দেখতে পারবেন। তাতে জনতারই মঙ্গল।’’

সমাজবিদ ও সাধারণ মানুষের চোখে অবশ্য এটা পিছনে হাঁটা। এবং পিছনে হেঁটে মানুষের মঙ্গল তো ছার, মানুষে-মানুষে দূরত্বের অসুখ বাড়বে বলেই আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন