যেন হিন্দি ফিল্ম, পুলিশের জালে বাহুবলী

রাজস্থানের মিরচি শেঠ বন্দুক পাচার করতেন। শুকনো লঙ্কার বস্তাবন্দি হয়ে বন্দুক-গুলি ছড়িয়ে পড়ত দেশে। তাঁকে ধরতে মুম্বই থেকে পুলিশকর্তা অজয় রাঠৌর (আমির খান) গিয়ে তাঁকে তো ধরেইছিলেন, সঙ্গে পাকড়াও করেন গুলফাম হোসেন (নাসিরুদ্দিন)-কেও। এ ছিল রূপোলি পর্দার টানটান ছবি।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ১৭:১৭
Share:

ধৃত ভৈরোঁ সিংহ (বাঁ দিকে)। নিজস্ব চিত্র।

রাজস্থানের মিরচি শেঠ বন্দুক পাচার করতেন। শুকনো লঙ্কার বস্তাবন্দি হয়ে বন্দুক-গুলি ছড়িয়ে পড়ত দেশে। তাঁকে ধরতে মুম্বই থেকে পুলিশকর্তা অজয় রাঠৌর (আমির খান) গিয়ে তাঁকে তো ধরেইছিলেন, সঙ্গে পাকড়াও করেন গুলফাম হোসেন (নাসিরুদ্দিন)-কেও। এ ছিল রূপোলি পর্দার টানটান ছবি।

Advertisement

বাস্তব জগতে রাজস্থানের ঝালোয়ার জেলার ভৈরোঁ সিংহ পাচার করতেন হেরোইন। অনেকটা ওই মিরচি শেঠ-এর ধাঁচেই। রাজস্থান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লরিতে করে চাল-ডাল থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি— যা-ই যাতায়াত করত, তার ভিতরেই ভৈরোঁ সিংহের হেরোইন পাচার হয়ে যেত। পুলিশ থেকে রাজনীতিবিদ, সবই ছিল ভৈরোঁ সিংহের হাতের মুঠোয়।

এ হেন ভৈরোঁ সিংহ কলকাতার একটি মামলায় ধরা পড়েছেন রাজস্থান পুলিশের হাতে। ১৩ বছর আগে সল্টলেকে হেরোইন সমেত ধরা পড়া দুই ব্যক্তির কাছ থেকে জানা গিয়েছিল ভৈরোঁ-র কথা। এত দিন অধরা ছিলেন ভৈরোঁ। শনিবার সকালে রাজস্থানের ঝালোয়ার জেলায় তাঁর বাড়ির কাছ থেকে ভৈরোঁ সিংহকে ধরে সেখানকার পুলিশ। শনিবারেই তাঁকে ট্রেনে করে কলকাতায় পাঠানোর সময়ে সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল ১১ জন পুলিশকর্মীকে! যার মধ্যে দু’জন ডিএসপি এবং ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার অফিসারও ছিলেন।

Advertisement

এক জন অভিযুক্তকে পাঠানোর জন্য ১১ জন পুলিশ!

ঝালোয়ার-এর পুলিশ সুপার রাজেন্দ্র সিংহ এ দিন ফোনে জানান, ভৈরোঁ ঝালোয়ার জেলার নামকরা বাহুবলী বলে পরিচিত। তাঁকে ধরা অত সহজ ছিল না। শনিবার সকালে তাঁকে ধরার পরে আর রাজস্থানে রাখতে চাননি তাঁরা। রাজেন্দ্র বলেন, ‘‘ভৈরোঁ গ্রেফতার হয়েছে, এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সমস্যা হতে পারত। শুধু মাদক নয়, অস্ত্রপাচারের সঙ্গেও ওঁর নাম জড়িত। তাই, তড়িঘড়ি তাঁকে স্থানীয় আদালতে তুলে ট্রানজিট রিম্যান্ড নিয়ে আমরা কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছি।’’ তা বলে সঙ্গে ১১ জন পুলিশ? রাজেন্দ্র-র কথায়: ‘‘আর্থিক বল তো আছেই, রাজনৈতিক প্রতিপত্তিও খুব কম নয় ভৈরোঁর। প্রচন্ড ক্ষমতাশালী। রাস্তায় যে কোনও সময়ে ওঁর দলের লোক ওঁকে ছিনতাই করে নিয়ে যেতে পারত। ভৈরোঁ সিংহের মতো দুষ্কৃতীর ক্ষেত্রে আমরা ঝুঁকি নিতে চাইনি।’’

সোমবার তাঁকে হাওড়া স্টেশনে এনে তুলে দেওয়া হয়েছে নারকোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো-র (এনসিবি) অফিসারদের হাতে। সোমবার রাতে তাঁকে রাখা হয়েছিল বিধাননগরের নিউটাউন থানার লকআপে। কড়া পুলিশি পাহারায়। মঙ্গলবার তোলা হয় বারাসত আদালতে। বিচারকের নির্দেশে এখন থেকে তাঁকে রাখা হবে বারাসত জেলে।

এনসিবি-র পূর্বাঞ্চলের ডিরেক্টর সুব্রত বিশ্বাস মঙ্গলবার জানান, ঘটনার সূত্রপাত ২০০২ সালে। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে সল্টলেকের রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন এনসিবি অফিসারেরা। একটি গাড়িকে আটকে তার ভিতর থেকে আনসার রহমান নামে এক ব্যক্তিকে সাড়ে তিন কিলোগ্রাম হেরোইন সমেত ধরা হয়েছিল। আনসারকে জেরা করে সল্টলেকের এজে ব্লকের একটি বাড়ি থেকে আরও ৫০ কিলোগ্রাম হেরাইন পাওয়া যায়। ধরা পড়েন দীপক গিরি। দীপক নেপালি, উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। আনসার কলকাতারই বাসিন্দা। ২ কিলোগ্রাম হেরোইন ও ৪৭ কিলোগ্রাম চরস সমেত তিনি কলকাতা পুলিশের হাতে ১৯৮৭ সালে ধরা পড়েছিলেন। সে বার তাঁর দশ বছরের সাজা ও ২ লক্ষ টাকা জরিমানা হয়। তবে, ১৯৯৩ সালে সাজা শেষ করে বেরিয়ে আসেন আনসার। আবার জড়িয়ে পড়েন মাদক চোরাচালানের সঙ্গে।

সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘আনসার ও দীপক আজও বারাসত জেলে বন্দি। মামলা চলছে।’’ তাঁদের জেরা করে প্রথমে দু’জন পাচারকারী এবং শেষে ভৈরোঁ সিংহের কথা জানা যায়। ওই দুই পাচারকারীকেও গ্রেফতার করা হয় এবং পরে তাঁরা জামিন পেয়ে যান। জানা যায়, মাদক পাচারের প্রধান হোতা ভৈরোঁই। তিনিই রাজস্থান থেকে ‘মাল’ পাঠান। আর তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ভৈরোঁ-কে ধরতে এনসিবি-র অফিসারেরা রাজস্থানে যান। কিন্তু, খালি হাতে ফিরে আসেন। খুঁজে পাওয়া যায়নি ভৈরোঁকে।

এর বছর তিনেক পরে জানা যায়, মুম্বই পুলিশ ধরেছে ভৈরোঁকে। তিনি আর্থার জেলে রয়েছেন। যোগাযোগ করা হয় মুম্বই পুলিশের সঙ্গে। জানানো হয়, কলকাতার একটি মামলায় খোঁজ চলছে ভৈরোঁর। তত দিনে বারাসত আদালত থেকে ভৈরোঁ-র নামে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়ে গিয়েছিল। মুম্বই পুলিশের সঙ্গে এনসিবি-র কথা মতো ঠিক হয়েছিল, মুম্বই-এর মামলায় অভিযুক্ত ভৈরোঁ-র সেখানকার জেল হেফাজতের মেয়াদ শেষ করলেই তাঁকে কলকাতার মামলায় নিয়ে আসা হবে এই শহরে। কিন্তু, ২০১০ সালে মুম্বই-এর মামলায় খালাস হয়ে আর্থার জেল থেকে বেরিয়ে রাজস্থান ফিরে যান ভৈরোঁ। সুব্রতবাবু জানান, মুম্বই পুলিশ সে সময়ে তাঁদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি। ফলে, কলকাতার মামলায় অধরাই থেকে যান এই বাহুবলী। ২০১০ সালেই ভৈরোঁ-র নামে নতুন করে গ্রেফতারি পরোয়ানা বার করা হয় বারাসত থেকে। তার পর থেকে এনসিবি খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাঁকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন