Gas Leak

‘কী ভাবে চিকিৎসা হবে, জানতেন না চিকিৎসকেরাও’

এত বছর পরেও এ দেশে শিল্প ক্ষেত্রে সতর্কতা কত কম, তা আজ ফের বোঝা গেল।

Advertisement

অনঘ গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২০ ০৩:২৯
Share:

রশিদা বি

বিশাখাপত্তনমের গ্যাস লিকের ঘটনা ১৯৮৪ সালে ভোপালের দুঃস্বপ্নের রাতের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে ভুক্তভোগীদের মনে।

Advertisement

তখন ভোপালের ২২ নম্বর ওয়ার্ডে থাকতেন প্রাক্তন প্রতিরক্ষাকর্মী প্রবীণ মালব্য। গ্যাস দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলির মধ্যে ছিল ওই ওয়ার্ড। ভোপাল থেকে ফোনে বললেন, ‘‘সে দিন রাতে পাশের বাড়ির বাসিন্দাদের কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারি কিছু একটা ঘটছে। জিজ্ঞেস করলেও তাঁরা কিছু বললেন না।’’ এর পরে বাবা-মা, বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন প্রবীণ। বললেন, ‘‘সারা শরীরে অদ্ভূত এক জ্বালা। তারই মধ্যে উদ্‌ভ্রান্তের মতো পালাচ্ছিলেন মানুষ। সকলেই বলছিলেন, পালাও, না-হলে বাঁচবে না। কেউ কেউ আবার বলছিলেন রাসায়নিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে।’’

কিছুটা হেঁটেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন প্রবীণের বাবা ও স্ত্রী। কোনওক্রমে তাঁদের নিয়ে শহরের শাহজহানি পার্কে পৌঁছন তিনি। তার পরে সংজ্ঞা হারান সকলেই। বললেন, ‘‘ভোরবেলা কিছুটা হুঁশ ফেরার পরে বুঝতে পারি ঘোষণা করা হচ্ছে গ্যাসের প্রভাব কমছে। এ বার বাড়ি ফেরা যেতে পারে।’’ বাড়ি ফেরার পরে তাঁদের দেখে প্রতিবেশীরা চমকে ওঠেন। প্রবীণ বলেন, ‘‘ওঁরা বলতে থাকেন, এ কি আপনাদের চোখ এমন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কেন?’’

Advertisement

ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা

কী হয়েছিল

• ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের রাসায়নিক কারখানায় গ্যাস লিকের ঘটনা ঘটে। কারখানার ‘সি প্ল্যান্ট’ সঞ্চিত মিথাইল আইসোসায়ানেটের ৬১০ নম্বর ট্যাঙ্কে কোনও ভাবে জল মিশে যায়। ফলে তাপদায়ী বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস। উদ্ভুত প্রচণ্ড তাপ ও চাপে ট্যাঙ্কের ভাল্‌ভ খুলে গিয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মিথাইল আইসোসায়ানেট।

মৃত্যু

• ৩৭৮৭ (সরকারি হিসেবে)

• বেসরকারি মতে, মৃতের সংখ্যা আট থেকে দশ হাজার।

কী গ্যাস

• মিথাইল আইসোসায়ানেট

গ্যাসের প্রতিক্রিয়ায়

• শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন ৫,৫৮,১২৫ জন।

• স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার ৩৯০০ জন।

• বিষাক্ত গ্যাস থেকে রক্ষা পায়নি মাতৃগর্ভে থাকা শিশুরাও। শতকরা ৪৩ জন মহিলার গর্ভস্থ শিশু মারা যায়। ঘটেছিল গর্ভপাতের ঘটনাও। ওই ঘটনার পরে ভোপালে যে সব শিশু জন্মেছিল, তাদের শতকরা ১৪ জনের মৃত্যু হয় জন্মের এক মাসের মধ্যে।

• কয়েক হাজার পশুপাখি মারা গিয়েছিল। ঝরে গিয়েছিল গাছের পাতা, ঘাস হলুদ হয়ে যায়। দূষিত হয়ে গিয়েছিল জল।

প্রবীণ জানালেন, গাঁধী মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসকেরা কী ভাবে চিকিৎসা করবেন তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বাঁচানো যায়নি প্রবীণের এক বছর বয়সি ছেলেকে। সে কথা বলতে গিয়ে এত বছর পরেও গলা বুজে আসে প্রাক্তন প্রতিরক্ষাকর্মীর। বললেন, ‘‘এত বছর পরেও এ দেশে শিল্প ক্ষেত্রে সতর্কতা কত কম, তা আজ ফের বোঝা গেল।’’

আরও পড়ুন: ভোপালের ছায়া বিশাখাপত্তনমে, গ্যাস লিকে মৃত ১১, অসুস্থ ১০০০

ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার জেরে শাস্তি হয়নি ইউনিয়ন কার্বাইড সংস্থার তৎকালীন সিইও ওয়ারেন অ্যান্ডারসন-সহ এক জন কর্তাও। কিছু ‘ক্ষতিপূরণ’ দিয়েই কার্যত দায় সারেন তাঁরা। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে এখনও মামলা চলছে। সেই লড়াইয়ে পক্ষ প্রবীণের পরিবারও।

গ্যাস দুর্ঘটনার জেরে পরিবারের আট জনকে খুইয়েছেন রশিদা বি। এখন ক্ষতিগ্রস্তদের আন্দোলনের অন্যতম মুখ। ভোপাল থেকে ফোনে বললেন, ‘‘সে রাতে প্রতিবেশীদের চিৎকারে বাড়ি ছেড়ে বেরোলেও আধ কিমিও যেতে পারিনি আমরা। শরীরে অসহ্য জ্বালা নিয়ে একটা পুকুরের পাশে বসে রাত কাটিয়েছিলাম। ভোর রাতে বলা হয়েছিল, ইউনিয়ন কার্বাইডের গেট বন্ধ হয়েছে। এ বার আপনারা বাড়ি ফিরতে পারেন।’’ হাসপাতাল নিয়ে প্রবীণের মতোই অভিজ্ঞতা রশিদার। বললেন, ‘‘চিকিৎসকেরা জানতেন না কী ভাবে চিকিৎসা করতে হবে। এ নিয়ে ইউনিয়ন কার্বাইডকে ফোনও করছিলেন তাঁরা। কিন্তু কার্বাইড কর্তৃপক্ষ সদুত্তর দেননি।’’ রশিদার কথায়, ‘‘শুধু নিজেদের জন্য নয়, ভোপালের মতো ঘটনা যাতে আর না ঘটে তা নিশ্চিত করতেও বছরের পর বছর লড়াই করছি। কিন্তু বিশাখাপত্তনম দেখাল, বদলায়নি প্রায় কিছুই।’’

আরও পড়ুন: ৩৬ বছর আগে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার স্মৃতি ফেরাল বিশাখাপত্তনম, কী ঘটেছিল সে দিন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন