দড়ি টানাটানির খেলায় গোড়ায় দাপট দেখিয়ে শেষ বেলায় যেন তার দম ফুরিয়ে গেল!
লড়াইটা কিন্তু তেড়ে-ফুঁড়েই শুরু করেছিল বর্ষা। প্রশান্ত মহাসাগরের ‘দুষ্টু ছেলে’ এল নিনো’র মুখে ছাই দিয়ে প্রথম ইনিংসে সে রীতিমতো টি-টুয়েন্টির মেজাজে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করেছে। বস্তুত জুনের শেষ পনেরো দিন, তামাম জুলাই, আর অগস্টের প্রথম সপ্তাহ— এই প্রায় দু’মাস সে এত বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারি হাঁকিয়েছে যে, গুজরাত-রাজস্থানের মতো ‘শুখা’ রাজ্যও তখন বানভাসি! বিহার, উত্তরপ্রদেশে ছাড়া দেশের মোটামুটি সব রাজ্যেই অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু ফাইনাল রাউন্ডে এসে ছবিটা বেবাক উল্টো। স্বমহিমায় ফিরে এসে এল নিনো প্রায় বোতলে পুরে নিয়েছে বর্ষাকে। উপরন্তু বাজিয়ে দিয়েছে বর্ষার বিদায়ঘণ্টাও। পরিণামে কৃষিক্ষেত্রে ত্রাহি রব। জুলাইয়ে অতিবৃষ্টির তালিকায় থাকা রাজ্যগুলোর সিংহভাগ এখন ঘাটতি বৃষ্টির মুখোমুখি। সেখানে ফসল মার খাওয়ার প্রভূত আশঙ্কা। যার সুবাদে শস্য-সঙ্কটের ছায়া ঘনিয়েছে সারা দেশে।
এ বছর বর্ষার মতি-গতি নিয়ে আবহবিদেরা প্রথম থেকেই ধন্দে ছিলেন। আম্তর্জাতিক আবহবিজ্ঞান সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০১৫ হল গিয়ে ‘এল নিনো’র বছর। এ বার এল নিনো শক্তিশালী হবে। তার জেরে ভারতীয় উপমহাদেশে শক্তি হারাবে মৌসুমি বায়ু। দিল্লির মৌসম ভবনও এপ্রিলের পূর্বাভাসে জানিয়ে দেয়, এ বার খরা-পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
তবে কিঞ্চিৎ দেরিতে ঢুকলেও প্রথম দফায় মৌসুমি বায়ুর মারমুখী চালচলন দেখে এ সব আশঙ্কা ধামাচাপা পড়ে যায়। জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বঙ্গোপসাগর-আরবসাগরে তৈরি হওয়া একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ ও ঘূর্ণাবর্তের দাপটে মৌসম ভবনের পূর্বাভাস নস্যাৎ হতে বসে। অসম, দক্ষিণবঙ্গ, গুজরাত-রাজস্থানের বন্যার প্রেক্ষিতে আবহবিদদের বিশ্লেষণ-পদ্ধতি নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। প্রশ্ন ওঠে, এল নিনো-র সঙ্গে কি এ দেশের বর্ষার আদৌ সম্পর্ক আছে?
বেকায়দায় পড়ে যায় মৌসম ভবন। কেন্দ্রীয় এক আবহবিজ্ঞানীর কথায়, “আমাদের উপরে মারাত্মক চাপ ছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম, বঙ্গোপসাগর-আরবসাগরের আপাত অস্থিরতা কাটলেই এল নিনোর আঁচ টের পাওয়া যাবে। আমরা ঠিকঠাকই পূর্বাভাস দিয়েছিলাম।”
এই মুহূর্তে সেটাই মালুম হচ্ছে। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র সারা দেশকে যে ৬৪০টি ‘অঞ্চলে’ ভাগ করেছে, জুলাইয়ের শেষাশেষি তার অর্ধেকই ছিল অতিবৃষ্টির তালিকায়। কিন্তু অগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে হাওয়া ঘুরতে শুরু করে। আর সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে আবহবিদদের ঘোষণা: প্রায় ২৮৩টি অঞ্চল অনাবৃষ্টিতে ধুঁকছে। কোথাও কোথাও বৃষ্টির ঘাটতির বহর এতটাই যে, খরার পদধ্বনি কানে আসছে। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, তেলঙ্গানা, কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রের অবস্থা সবচেয়ে সঙ্গিন।
এবং এ হেন পরিস্থিতির মধ্যে সিঁদুরে মেঘ দেখছে কৃষি মন্ত্রক। কারণ তাদের হিসেব বলছে, দেশে উৎপাদিত মোট ফসলের ৭৫ শতাংশেরই জোগান আসে এই তল্লাট থেকে। তাই ওখানে চাষ মার খেলে গোটা দেশেই খাদ্য সরবরাহে টান পড়তে বাধ্য। ‘‘এই অবস্থাটা দু’মাস আগে দেখা দিলে এত চিন্তার কিছু ছিল না। পরে ভাল বৃষ্টি হয়ে ছবিটা ঘুরে যাওয়ার সুযোগ থাকত। এখন সে সুযোগ নেই।’’— আক্ষেপ করছেন এক আবহবিজ্ঞানী। কেন নেই?
মৌসম ভবনের ব্যাখ্যা: অনাবৃষ্টির অঞ্চলগুলি থেকে বর্ষার পাততাড়ি গুটোনো স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ওখানে আর ভাল বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আবহবিদদের দাবি, মৌসুমি বায়ুর যে প্রবাহটি এখনও টিকে রয়েছে, এল নিনো তাকে শুধু দুর্বলই করে দিচ্ছে না, তার বিদায়লগ্নকেও এগিয়ে আনছে।
অর্থাৎ, সুরাহার আশা দূর অস্ত্। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে বলেই মৌসম ভবনের আশঙ্কা।