Election Commission Of India

অনুপস্থিত! প্রশ্ন সংখ্যাবৃদ্ধিতে

নির্বাচন কমিশনের তথ্য খতিয়ে দেখে বিরোধী দলগুলি ফের অভিযোগ তুলছে, বিজেপি ও নির্বাচন কমিশন আঁতাঁত করে পশ্চিমবঙ্গে বিপুল সংখ্যক ভোটারদের নাম বাদ গিয়ে বিধানসভা ভোটে জিততে চাইছে।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৪৭
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

বাবা-মায়ের ভুল নাম ব্যবহার করে এসআইআর-এ বংশানুক্রমিক মিল দেখানো হচ্ছে। সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায় এ ভাবেই অনুপ্রবেশকারীরা ভোটার তালিকায় ঢুকে পড়ছে— বিজেপির থেকে বার বার এই অভিযোগ পেয়ে ভোটার-তথ্য পুনর্যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তার ফলে ভোটার তালিকায় কত জন অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করা গিয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। যদিও পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় ‘অনুপস্থিত’-এর সংখ্যা ‘অস্বাভাবিক’ হারে বেড়ে গিয়েছে। লাফিয়ে বেড়েছে স্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিত বলে চিহ্নিতদের সংখ্যাও।

নির্বাচন কমিশনের এই তথ্য খতিয়ে দেখে বিরোধী দলগুলি ফের অভিযোগ তুলছে, বিজেপি ও নির্বাচন কমিশন আঁতাঁত করে পশ্চিমবঙ্গে বিপুল সংখ্যক ভোটারদের নাম বাদ গিয়ে বিধানসভা ভোটে জিততে চাইছে। অনুপ্রবেশকারী বা ভুয়ো ভোটারের যুক্তিতে নাম কাটার ফলে সাধারণ মানুষের হয়রানি বাড়তে চলেছে। কারণ, ভোটার তালিকার মধ্যে থেকে যাঁদের অনুপস্থিত বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে, বিনা নোটিসেই এসআইআর-এর খসড়া তালিকায় তাঁদের নাম বাদ চলে যাবে।

নির্বাচন কমিশন প্রথমে ঠিক করেছিল, ৪ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গে এনুমারেশন ফর্ম বা গণনাপত্র জমার কাজ শেষ হবে। ৩০ নভেম্বর কমিশন ঘোষণা করে, সময়সীমা বাড়িয়ে ১১ ডিসেম্বর করা হচ্ছে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন জানায়, যে সব ফর্ম নথিবদ্ধ হয়ে গিয়েছে, তার মধ্যে এএসডিডি (অ্যাবসেন্ট, শিফ্টেড, ডেড, ডুপ্লিকেট) বা অনুপস্থিত, স্থানান্তরিত, মৃত ও ডুপ্লিকেট ভোটারদের ফর্মও রয়েছে। তার পর থেকেই যে সব ফর্ম জমা পড়ে নথিবদ্ধ বা ‘আপলোড’ হয়ে গিয়েছিল, সে সব ‘রোল-ব্যাক’ করে পুনর্যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়। তার ফল কী হয়েছে?

৩ ডিসেম্বরের নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ৭.৬৬ কোটি ভোটারের মধ্যে ৫০.২২ লক্ষ ভোটারের ফর্ম ‘এএসডিডি’ বলে চিহ্নিত হয়েছিল। যার মধ্যে অনুপস্থিত বা ‘অ্যাবসেন্ট’ ৮ লক্ষ। এ ছাড়া স্থানান্তরিত ১৭ লক্ষ, মৃত ২৩ লক্ষ, ডুপ্লিকেট ভোটার ১.৫০ লক্ষ ছিল। ১১ ডিসেম্বর এনুমারেশন ফর্ম জমার কাজ শেষ হয়েছে। সে দিনের হিসেব বলছে, ‘এএসডিডি’ ভোটারের সংখ্যা বেড়ে ৫৮.০৮ লক্ষ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, নাম বাদ যাওয়ার তালিকা এক সপ্তাহে প্রায় ৮ লক্ষ বেড়েছে। এর মধ্যে শুধু ‘অনুপস্থিত’ ভোটারের সংখ্যাই ৪ লক্ষ বেড়েছে। স্থানান্তরিত ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩ লক্ষ। মৃত ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে ১ লক্ষের মতো। ডুপ্লিকেট ভোটারের সংখ্যা আবার কিছুটা কমে গিয়েছে। ১১ ডিসেম্বরের হিসেবে, অনুপস্থিত, স্থানান্তরিত, মৃত ও ডুপ্লিকেট বলে চিহ্নিত ৫৮.০৮ লক্ষ ভোটারের মধ্যে অনুপস্থিত ১২.০১ লক্ষ। স্থানান্তরিত ১৯.৯৩ লক্ষ। মৃত ২৪.১৮ লক্ষ। ডুপ্লিকেট ভোটারের সংখ্যা ১.৩৭ লক্ষ।

এই পুনর্যাচাইয়ের জন্যই ৬ ডিসেম্বর থেকে বিএলও-দের ভোটার-তথ্যের যুক্তিগত অসঙ্গতি নতুন করে খতিয়ে দেখতে ‘রি-ভেরিফাই লজিকাল ডিসক্রিপেন্সিস’ নামে নতুন কলাম সংযোজন হয়েছে। ভোটাররা ২০০২-এ তালিকা থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে যে সম্পর্ক দেখিয়েছেন, সেই ‘প্রোজেনি ম্যাপিং’ পুনর্যাচাই করা হচ্ছে। যেমন, বাবা বা মায়ের নাম যা দেখানো হয়েছে, সেখানে তথ্যগত গরমিল হলে, বাবার সঙ্গে সন্তানের বয়সের ফারাক খুবই কম হলে, নামের বানান গরমিল হলে, তা খতিয়ে দেখতে হচ্ছে। ১১ ডিসেম্বর এনুমারেশন ফর্ম জমার পর থেকে ১৬ ডিসেম্বরের খসড়া তালিকা প্রকাশের আগের দিন পর্যন্ত এই পুনর্যাচাই করার সময় দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সূত্রের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে এই পুনর্যাচাইয়ের কাজ করে সাফল্য মিলছে। কিন্তু অন্য রাজ্যে তা করতে যাওয়ায় সে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকেরা বাড়তি সময় চেয়েছেন। তাই উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু-সহ ছয় রাজ্যে এনুমারেশনের কাজের সময় ফের সাত দিন বাড়ানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সময় বাড়ানো হয়নি।

পুনর্যাচাই করতে গিয়ে ‘অনুপস্থিত’-এর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে কেন? এর কোনও উত্তর নেই নির্বাচন কমিশনের কাছে। বিরোধীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এঁদের মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিক থাকতে পারেন। কেউ কাজের বা পারিবারিক প্রয়োজনে বাইরে থাকতে পারেন। একেবারে বিনা নোটিসে এঁদের নাম বাদ চলে যাবে। খসড়া তালিকা প্রকাশের পরে তাঁদের আবার ফর্ম-৬ পূরণ করে নতুন ভোটার হিসেবে নাম তোলা ছাড়া উপায় থাকবে না। কমিশন সূত্রের খবর, সেখানেও প্রয়োজনে যাচাই করা হবে।

তৃণমূলের অভিযোগ, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এক কোটি ভোটারের নাম বাদ যাবে বলেছিলেন। নির্বাচন কমিশন যেন-তেন-প্রকারেণ সেই সংখ্যার কাছাকাছি পৌঁছতে চাইছে। তাই দিল্লি থেকে নির্বাচন কমিশন রাজ্যের বিএলও-দের এক কোটি ৬০ লক্ষ ভোটারের তথ্য যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর নিয়ে তৃণমূলের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলাকারী দোলা সেনের অভিযোগ, “বিজেপি একুশের ভোটে দু’শো পারের লক্ষ্য স্থির করেও হেরে গিয়েছিল। ছাব্বিশের ভোটে জিততে বিজেপি ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবাপন্ন পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের ভোট কাটতে চাইছে।” প্রদেশ কংগ্রেসের এসআইআর কমিটির প্রধান প্রসেনজিৎ বসুর বক্তব্য, “পুনর্যাচাইয়ের পরে এএসডিডি ফর্মের সংখ্যা আট লক্ষ বেড়ে গেল, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। বাড়তি আট লক্ষ ফর্মের মধ্যে মৃত ভোটারের সংখ্যা মাত্র ১.১৮ লক্ষ, অথচ চার লক্ষ বাড়তি ফর্ম ‘অনুপস্থিত’ হিসেবে এবং ২.৯৩ লক্ষ বাড়তি ফর্ম ‘স্থায়ী ভাবে স্থানান্তারিত’ হিসেবে তালিকায় চলে এসেছে।” প্রসেনজিতের প্রশ্ন, মৃত অথবা ডুপ্লিকেট ভোটার যাচাই করা সহজ। জন্ম-মৃত্যুর এবং আধার-এর তথ্যভান্ডার ও ‘ডি-ডুপ্লিকেশন সফটওয়্যার’ ব্যবহার করে তা করা যায়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের আধিকারিক বা পর্যবেক্ষকেরা কী ভাবে এক সপ্তাহের মধ্যে বাড়তি প্রায় সাত লক্ষ ‘অনুপস্থিত’ বা ‘স্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিত’ ভোটারদের চিহ্নিত করলেন? তাঁর বক্তব্য, সারা রাজ্যে এএসডিডি ফর্মের সংখ্যা ৭.৬৬ কোটি ভোটারের মধ্যে যেখানে ৫৮ লক্ষ, অর্থাৎ ৭.৬ শতাংশ, সেখানে কলকাতার বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে এর হার ২০ শতাংশের বেশি। নির্বাচন কমিশনের এর ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত।

নামের বানানের গরমিল নিয়ে নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, পদবির একাধিক বানান, কুমার থাকা-না-থাকা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। অনেকে বাংলা ফর্ম ইংরাজি ভাষায় পূরণ করেছেন, ইংরেজি ফর্ম বাংলায়। কমিশন এ সব বুঝে পদক্ষেপ করবে। ভোটারদের সমস্যা হবে না। শুধু দেখা হবে, ২০০২ সালের এসআইআরের সঙ্গে তাঁর নিজের অথবা মা-বাবা, ঠাকুরদা-ঠাকুমার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিকমতো মিলছে কি না। না থাকলে শুনানিতে ডাকা হবে। যদিও অনুপস্থিত বলে দাগিয়ে দেওয়াদের শুনানির আগেই নাম বাদ যাবে। বিহারের এসআইআর-এ একই অভিযোগ উঠেছিল। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের অভিযোগ, “নির্বাচন কমিশন কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই কাজ করতে শুরু করেছে। তাই বার বার নিয়ম পাল্টাচ্ছে। বাপ-ঠাকুরদার নথি আমাদের কেন জোগাড় করতে হবে? আমরা স্পষ্ট বলেছি, কোনও বৈধ ভোটারের নাম যেন বাদ না যায়। তেমনই মৃত ভোটারের নামও তালিকায় থাকবে না। এর দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন