বিপর্যয়ের উৎসমুখেই বসে কলকাতা

রিখটার স্কেলে ৮-৯ না হোক, ৬.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে কলকাতা যখন-তখন কেঁপে উঠতে পারে। মহানগরের মাটির সাড়ে চার কিলোমিটার নীচে ভূস্তরে একটি চ্যুতির অবস্থান যাচাই করে ও সেখানে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ অনুমান করে এমনই হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩২
Share:

রিখটার স্কেলে ৮-৯ না হোক, ৬.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে কলকাতা যখন-তখন কেঁপে উঠতে পারে। মহানগরের মাটির সাড়ে চার কিলোমিটার নীচে ভূস্তরে একটি চ্যুতির অবস্থান যাচাই করে ও সেখানে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ অনুমান করে এমনই হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।

Advertisement

এবং কলকাতার বিভিন্ন অংশে, বিশেষত জলাশয় বুজিয়ে মাথা তোলা বসতি অঞ্চলে এ হেন কম্পাঙ্কের ভূমিকম্প সমূহ ধংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে বলে জানিয়েছেন আইআইটি খড়্গপুরের ভূ-পদার্থবিদ্যার গবেষকেরা। গত ক’বছর ধরে ওঁরা সমীক্ষা চালিয়ে আন্দাজ পেতে চাইছেন, কলকাতা কতটা ভূমিকম্পপ্রবণ। কী পর্যবেক্ষণ ওঁদের?

গবেষকদলের প্রধান শঙ্করকুমার নাথ বলেন, কলকাতার ভূগর্ভে সাড়ে চার কিলোমিটার নীচে রয়েছে একটি চ্যুতি, ভূ-বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম ‘ময়মনসিংহ-কলকাতা হিঞ্জ’ বা ‘ইওসিন হিঞ্জ।’ সেখানে যা শক্তি সঞ্চিত রয়েছে, তার জোরে মহানগরে যে কোনও দিন ৬.৫ রিখটার মাত্রার ভূমিকম্প তৈরি হতে পারে। যদিও তার আগাম পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। ‘‘ঠিক যেমন শনিবার কাঠমান্ডুর কাছে দু’টি প্লেটের খাঁজে যে ভূমিকম্পটি ঘটেছে, তারও পূর্বাভাস দেওয়া যায়নি।’’— মন্তব্য শঙ্করবাবুর।

Advertisement

কলকাতায় সম্ভাব্য ভূকম্পের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আইআইটি’র ওই ভূ-বিজ্ঞানী নেপালেরই উদাহরণ টেনেছেন। তাঁর বক্তব্য: ওখানে দুই প্লেটের খাঁজে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সেটি নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করতে পারছিল না। এমতাবস্থায় আরও শক্তি অর্জনের তাগিদে একটি প্লেট অন্যটির মধ্যে ঢুকে যেতে থাকে। যার জেরে ভূমিকম্পের উৎপত্তি। ‘‘একই ভাবে ‘ইওসিন হিঞ্জে’ সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ লাগামছাড়া হয়ে উঠলে সেখানেও একটা প্লেট অন্যের তলায় ঢোকার চেষ্টা করবে। এতে কলকাতায় ভূমিকম্প হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা।’’— বলছেন আইআইটি’র ভূ-পদার্থবিদ্যার গবেষকেরা।

পাশাপাশি কলকাতার বিপদ বাড়াচ্ছে মাটির নীচে থাকা সাত কিলোমিটার পুরু পলিমাটির স্তর।

কী ভাবে?

শঙ্করবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘ভূগর্ভের কম্পন পলিমাটির ভিতর দিয়ে উপরে ওঠার পথে ঘুরতে ঘুরতে উঠবে। কম্পন যত বেশি সময় ধরে পলিমাটির স্তরের মধ্যে ঘূর্ণিপাক খাবে, ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছানো কম্পনের তীব্রতা তত বাড়বে।’’

এর ফলে সাড়ে ছয় রিখটারের ভূমিকম্পেও এখানে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা অনেক বেশি থাকছে বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। শঙ্করবাবুর হুঁশিয়ারি: রাজারহাট-সল্টলেকের একাংশ, ভিআইপি রোডের দু’পাশ ও ইস্টার্ন বাইপাসের দু’ধারে জলা-জমি ভরাট করে গজিয়ে ওঠা জনবসতি অঞ্চলে ভূমিকম্পের প্রভাব পড়বে সর্বাধিক। কারণ, সেখানে ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গে মাটির নীচের জল উপরে উঠে আসবে, যা কিনা মাটির স্তরকে নরম করে ফেলবে। এতে মাটি দ্রুত বসে যাওয়ার সম্ভাবনা। তেমনটা হলে ওই তল্লাটের ঘর-বাড়ি-আবাসন বসে যাবে। উঁচু বাড়ি ভেঙে পড়াও বিচিত্র নয়। বস্তুত কলকাতার এমন এলাকাগুলোই ছিল আইআইটি’র সমীক্ষার অন্যতম মূল লক্ষ্য।

দেশের কোন জায়গা কতটা ভূকম্পপ্রবণ, তার ভিত্তিতে একটি মানচিত্র তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যুরো অব স্ট্যান্ডার্ডস (বিআইএস)। সেটা করতে গিয়ে ভূকম্পপ্রবণতার নিরিখে পাঁচটি মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছে। ‘জোন-১’ ধরা হয়েছে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত অঞ্চলকে, মানে যেখানে ভূমিকম্পের কোনও সম্ভাবনা নেই। যদিও তেমন এলাকা ভারতীয় ভূখণ্ডে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানচিত্র শুরুই হয়েছে জোন-২, অর্থাৎ ‘সামান্য ভূকম্পপ্রবণ’ অঞ্চল দিয়ে। আর প্রবল ভূমিকম্পপ্রবণ জায়গাগুলি চিহ্নিত হয়েছে ‘জোন-৫’ হিসেবে। ওই মানচিত্রে কলকাতার অবস্থান জোন ৩ ও ৪-এর মাঝামাঝি।

অর্থাৎ, কলকাতা শহরে ভূমিকম্পের বিলক্ষণ সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দিচ্ছে বিআইএসের মানচিত্র। তবে মহানগরের কোন এলাকা কতটা ভূমিকম্পপ্রবণ, সে সম্পর্কে তাতে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য নেই। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (জিএসআই)-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৭৯৭ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত মোট ৬৭টি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা ও তার আশপাশ। এর কয়েকটির মাত্রা এত কম ছিল যে, ভূপৃষ্ঠে কম্পন অনুভবই করা যায়নি।

এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রক বৃহত্তর কলকাতার প্রতিটি এলাকা ধরে ধরে সেখানকার ভূগর্ভ-পরিস্থিতি যাচাই করার দায়িত্ব দেয় আইআইটি খড়্গপুরকে। শঙ্করবাবু জানান, শিবপুরের আইআইইএসটি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নগরোন্নয়ন দফতরের সঙ্গে মিলে তাঁরা সমীক্ষাটি চালিয়েছেন। সমীক্ষায় আর কী কী মিলল?

শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘আমরা কলকাতায় এমন কয়েকটা জায়গা পেয়েছি, ভূমিকম্প প্রবণতার নিরিখে যা জোন ৪-এরও গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু জায়গা আবার জোন ৩-এর নীচে।’’ ওঁর দাবি, নির্বিচারে ভূগর্ভের জল তুলে নেওয়ায় কলকাতার ভূস্তরের অবস্থা কতটা বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে, সমীক্ষায় তারও আঁচ মিলেছে।

কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, আইআইটি’র তরফে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সমীক্ষকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ‘‘আমরা জানি যে, সমীক্ষার কাজ শেষ। তবে তাতে কী পাওয়া গিয়েছে, এখনও জানি না।’’— বলছেন এক পুর-কর্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন