কারখানায় কাজ নেই, মন মজেছে কাশ্মীরে!

মন্দার ছায়া ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে দেশের গাড়ি শিল্পে। বিক্রি কমছে, ফলে উৎপাদনও। কাজ হারাচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক। দিল্লি-জয়পুর হাইওয়ের পাশে গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায় আগে তিন শিফ্‌টে কাজ হত। এখন মোটে একটা।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

গুরুগ্রাম শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:০৫
Share:

মন্দার জেরে কাজে ভাটা দিল্লি-জয়পুর হাইওয়ের পাশে গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায়। নিজস্ব চিত্র

কারখানার ফটকের বাইরে উড়ছে ইউনিয়নের লাল ঝাণ্ডা। ফটক পেরিয়েই ইউনিয়নের অফিসের দেওয়ালে শহিদ ভগৎ সিংহের ছবি। কারখানায় কাজের চাপ নেই দেখেই বোঝা যায়। ইউনিয়ন অফিসের জটলায় দুশ্চিন্তার মেঘ ঘুরপাক খাচ্ছে।

Advertisement

দিল্লি-জয়পুর হাইওয়ের পাশে গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায় আগে তিন শিফ্‌টে কাজ হত। এখন মোটে একটা। তার পরেও মারুতি-হন্ডার গাড়ির সাইলেন্সার, হিরোর মোটরবাইকের হ্যান্ডল তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। কারখানার ট্রাক মাসের পর মাস দাঁড়িয়ে। মালপত্র বারই হচ্ছে না। ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পবন যাদবের মুখে বিরক্তি, ‘‘মারুতি-হন্ডা-হিরোর থেকে অর্ডারই আসছে না। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে এই অবস্থা। এক বছর হতে চলল!’’

এই এক বছরেই মোদী সরকার ফের ক্ষমতায় ফিরেছে। হরিয়ানা থেকে বিজেপি লোকসভার দশের মধ্যে দশটি আসনই জিতেছে। প্রশ্নটা তাই করা গেল— মোদীজি সব সামলে ফেলবেন নিশ্চয়ই? চকিতে পবনের মুখে হাসি ফুটল। ‘‘দেখুন, ভোটটা মোদীজিকেই দিয়েছিলাম। আবার বিজেপি-কেই ভোট দেব। পুলওয়ামার জবাবটা কেমন বালাকোটে গিয়ে পাকিস্তানের ঘুরে ঢুকে দিয়ে এসেছিলেন, বলুন তো! এ বার প্রধানমন্ত্রী হয়েই কেমন তুড়ি বাজিয়ে কাশ্মীরে সবাইকে সিধে করে দিলেন, দেখেছেন তো?’’

Advertisement

পবনদের কারখানায় ৫৬৭ জন কর্মী। ২৬ বছরের পুরনো কারখানায় এত দিন ছয় মাসে এক বার সাত দিন কাজ বন্ধ থাকত। যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫ দিন কাজ বন্ধ ছিল। জুনে ফের ১০ দিন। এখন কারখানা চলছে। কিন্তু অধিকাংশ কর্মীর হাতেই কাজ নেই। হাল শোধরাতে মালিক রেলের যন্ত্রাংশ তৈরির বরাত নিয়েছেন।

কাশ্মীরে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করে আপনাদের কারখানায় কাজ ফিরবে কি? পবনের সাঙ্গোপাঙ্গরা রে রে করে ওঠেন— ‘‘কী লাভ হল শুনবেন! হরিয়ানার সব পরিবারেই কেউ না কেউ সেনায় কাজ করে। কাশ্মীরিরা আমাদের বাড়ির ছেলেদের দিকেই পাথর ছুড়ত। এত দিন কেন এ সব চলেছে? কেন সেনার অপমান হবে? মোদীজি আর এ সব বরদাস্ত করবেন না।’’

যদিও ইউনিয়নের সঙ্গে কোনও বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনের সরাসরি সম্পর্ক নেই, কিন্তু গুরুগ্রামের এই সব কারখানায় বামপন্থী শ্রমিক নেতাদের আনাগোনা লেগে থাকে। বরং এ তল্লাটে আরএসএসের শ্রমিক সংগঠন বিএমএসের তেমন প্রভাব নেই। তাতে অবশ্য মোদীর কোনও সমস্যা হয়নি।

পবনদের কারখানায় মাসে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকার ওভারটাইম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শ্রমিক-কর্মচারীদের এক সুরে প্রশ্ন, ‘বলুন তো, আমরা কেন কাশ্মীরে গিয়ে জমি কিনতে পারব না?’

নভেম্বরে হরিয়ানায় ভোট। এখন থেকেই বিজেপির প্রচার তুঙ্গে। ও দিকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার কংগ্রেস এখনও ঘর গুছোতেই পারেনি। বিজেপির মনোহরলাল খট্টর সরকার ফের ক্ষমতায় ফিরতে স্লোগান তুলেছে— ‘অব কি বার, পঁচাত্তর পার’। ৯০ আসনের বিধানসভায় ৭৫টিই দখলের লক্ষ্য। রাস্তা জুড়ে সেই হোর্ডিং।

হাইওয়ে ছেড়ে ঢুকে পড়া গেল ধারুহেরার সঙ্গওয়ারি, লাধুবাসের গ্রামের রাস্তায়। গুরুগ্রামে যখন গাড়ি শিল্প গড়ে উঠছে, তখন কারখানার জন্য জমি বেচে পাওয়া টাকায় এই সব গ্রামের লোকেরা বাড়ির উঠোনেই ছোট ব্যবসা খুলেছিলেন। স্ক্রু, নাট-বোল্ট তৈরির জন্য বাড়িতেই ছোট যন্ত্র বসানো। গাড়ির যন্ত্রাংশ কারখানায় বরাত মেলে। পাঁচ থেকে দশ জনের রুটিরুজি। বাড়ির বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, ভিতরে কারখানা চলছে। ‘‘চলছে না। মেশিন সব বন্ধ। এখন উপরওয়ালাই ভরসা’’— বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুনীল কুমার আকাশের দিকে আঙুল দেখান। পবনদের ইউনিয়ন অফিসে ভগৎ সিংহের ছবির পাশে ব্যাঘ্রবাহিনী দুর্গার ফ্রেম বাঁধানো ছবি বসেছে। কারখানা চত্বরে শিরডির সাইঁবাবার ছোট্ট মন্দিরে রোজ পুজো হয়। বিদায় নেওয়ার সময় পবন যাদবও একটা প্রণাম ঠুকে বলেন, ‘‘দেখবেন, মোদীজি ঠিক সব সামলে নেবেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন