ছবিটা মনে আছে! স্কুলের দেওয়াল বেয়ে উঠছে কিছু লোক। সেই স্কুলের ভিতরে পরীক্ষা দিচ্ছে ছেলেমেয়েরা। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রথমে ছাপা হয় ছবিটি। বিহারের সেই গণটোকাটুকির ছবি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ঝড়় তুলেছিল।
বছর বদলে গেলেও ছবিটা খুব একটা পাল্টায়নি। উল্টে দিনের পর দিন আরও খারাপ হচ্ছে। দিল্লির প্রাক্তন আইন মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ তোমরের আইনের ডিগ্রি নিয়ে তদন্ত শুরু হতেই ছবিটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। শুধু তোমরের আইনের ডিগ্রি নয়, বিএ, বিএসসি, এলএলবি, বিএইচএমএস-সহ প্রায় সমস্ত ডিগ্রি কিছু কিছু কলেজে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে। গাঁটের কড়ি ফেললেই পাওয়া যাচ্ছে ডিগ্রি। পরীক্ষার মরসুম আসতেই ভিড়় লেগে যায় মুঙ্গের-ভাগলপুরে। ভিন্ রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের সেই ভিড়়ের একটাই লক্ষ্য। যেমন ভাবেই হোক একটা ডিগ্রি হাসিল করা। দু’দশক ধরে চলে আসা সেই ‘ঐতিহ্য’-এ এখনও ফিকে হয়নি।
এই প্রথম নয়, ১৯৯৬ সালে মাধেপুরার বি এন মণ্ডল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টাকা নিয়ে বিএড ডিগ্রি বিক্রি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। সেই অভিযোগের জেরে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ যাদবকে জেলে যেতে হয়েছিল। আর যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি হাসিল করার দাবি করেছিলেন জিতেন্দ্র তোমর, সেই ভাগলপুরের তিলকা মাঝি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসও কম ‘গৌরবশালী’ নয়। অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মুঙ্গেরের যে সমস্ত কলেজে পরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে সেখানে রীতিমতো মাফিয়া রাজ চলে। বিশ্ববিদ্যালয়স্তরের পরীক্ষার উত্তরপত্র বাড়়িতে নিয়ে গিয়ে উত্তর লিখে পরীক্ষা কেন্দ্রে জমা দিয়ে যাওয়া হয়। স্বাভাবিক ভাবেই পরীক্ষায় ফল ভাল হওয়ার সম্ভবনা একশো শতাংশ পাকা। চলতি বছরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বসেছেন রামাশ্রয় প্রসাদ যাদব। উপাচার্য হওয়ার পরেই তিনি মুঙ্গেরের সমস্ত পরীক্ষা কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সমস্ত পরীক্ষা কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে তুলে আনেন। এর জেরে ক্ষোভে ফেটে পড়়ে মুঙ্গেরের কলেজ কর্তৃপক্ষ। মাসখানেক ধরে পরীক্ষা কেন্দ্র ফেরানোর দাবিতে আন্দোলনও হয়।
যে কলেজ থেকে জিতেন্দ্র তোমর পাশ করেছিলেন বলে দাবি করেছেন, সেই বিএন সিংহ আইন কলেজ ডাকযোগে আইনের ডিগ্রিও দেয়। পশ্চিমবঙ্গ, ওড়়িশা, ঝাড়়খণ্ড, ছত্তীস্গঢ়় থেকে শুরু করে নেপালের অনেকেই এই কলেজ থেকে আইনের ডিগ্রি নিয়েছেন। এক বার কলেজে নাম লেখালেই ডিগ্রি পাওয়া নিশ্চিত। এ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ জমা পড়়েছে। তদন্তও হয়েছে। ওই পর্যন্তই, রিপোর্ট মেলেনি।
টাকা দিলে যে ডিগ্রি পাওয়া যায় সম্প্রতি তারও প্রমাণ মিলেছে। বাঁকা জেলার বাসিন্দা অমৃত কুমার মুঙ্গেরের টেম্পল অফ হ্যানিম্যান হোমিওপ্যাথি কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পড়়াশোনা করেছেন বলে দাবি করেছেন। পড়়াশোনা শেষ করে শংসাপত্র নিতে গেলে কলেজের অধ্যক্ষ সরযুগ কুমার ৬৫ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে কোনও ভাবেই শংসাপত্র পাওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেন। বাঁকা জেলার বাসিন্দা অমৃত কুমারও বাঘা তেঁতুল। গোটা বিষয়টি নিয়ে পৌঁছে গেলেন পটনায় রাজ্য দুর্নীতি দমন বিভাগে। এরপরে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ নিতে গিয়ে গত সপ্তাহে দুর্নীতি দমন বিভাগের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন অধ্যক্ষ। তদন্তকারীদের তিনি জানিয়েছেন, এর আগেও টাকা দিয়ে ডিগ্রি দিয়েছেন তিনি। অমৃত কুমারের সঙ্গেও তাঁর সেই চুক্তিই হয়েছিল। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন শাখা।
শুধু সরযুগ কুমার নন, অধ্যক্ষ নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির জেরে গ্রেফতার হয়েছেন মগধ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রাক্তন উপাচার্য অরুণ কুমার। তাঁর সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন বখতিয়ারপুরের রামলখন সিংহ কলেজের প্রবীণ কুমার। এক ডজন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে এফআইআর দায়ের হয়েছে। কয়েক দিন আগেই গণ টোকাটুকির জেরে বাতিল হয়েছে বিহারের সমস্তিপুরের মহিলা কলেজের বিএসসি ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা।
সব মিলিয়ে বিহারের শিক্ষা ব্যবস্থায় জঙ্গলরাজে ইতি টানতে পারেননি নীতীশ কুমারও।