বিক্ষোভ: পুলিশ-কৃষক সংঘর্ষ। মঙ্গলবার দিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
চার-চারটি লোহার ব্যারিকেড। মিছিলের একেবারে সামনে থাকা ট্র্যাক্টর তাতে ধাক্কা মারতেই ছুটে এল জল-কামান।
প্রবল জলের তোড়ে না দমে মিছিল আরও একটু এগোতেই এ বার এল কাঁদানে গ্যাস। সেই সঙ্গে বেপরোয়া লাঠি।
ঠিক কুড়ি কিলোমিটার দূরে রাষ্ট্রপতি ভবনে তখন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর জন্মদিনে অহিংসার কথা বলছেন নরেন্দ্র মোদী। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মদিনে ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান’ স্লোগান মনে করাচ্ছেন নেতারা। আর উত্তরপ্রদেশ-দিল্লি সীমানায় তখন খণ্ডযুদ্ধ চলছে জওয়ানে-কৃষকে! পুলিশের হামলায় রক্তাক্ত কৃষক লুটোপুটি খাচ্ছেন রাস্তায়।
উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা কৃষক করতার সিংহের কথায়, ‘‘কৃষক কি জঙ্গি? দাবি জানাতে দিল্লিও যেতে পারব না? দাবি রাখতে কি পাকিস্তানে যেতে হবে?’’ পুলিশের লাঠি খাওয়া আর এক কৃষক অশোক ত্যাগীর কথায়, ‘‘নাম বদলে অম্বানী রাখলে কি ঋণ মাফ আর মোদীর প্যাকেজ— দু’টোই পাব? পরের লোকসভায় গদি সামলে রাখুন মোদী-যোগী!’’
প্রয়াত কৃষক নেতা মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েতের বড় ছেলে নরেশের নেতৃত্বে হরিদ্বার থেকে ‘কিসান ক্রান্তি যাত্রা’ আজ গাঁধী জয়ন্তীতে দিল্লি আসার কথা আগেই ছিল। ‘ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন’-এর ব্যানারে চৌধরি চরণ সিংহের সমাধি ‘কিসান-ঘাটে’ গিয়ে সরকারের কানে নিজেদের দাবি পৌঁছনোই লক্ষ্য ছিল কৃষকদের। গত ৯ দিনে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ থেকে নির্বিঘ্নেই এগিয়েছে মিছিল। কিন্তু আজ দিল্লি ঢোকার মুখেই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল। মোদী সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা দিল্লি পুলিশের পাশাপাশি আরএএফ, দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ বাহিনী মোতায়েন ছিল কাল রাত থেকে। আজ তারাই আটকে দিল কৃষকদের। দু’রাজ্যের সীমানায়।
নরেন্দ্র মোদী আজ দিনভর ব্যস্ত গাঁধীর কথা বলতে। তাই কৃষকদের সঙ্গে কথা বলতে পাঠালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে। যোগীর দুই মন্ত্রী, কেন্দ্রের কৃষি প্রতিমন্ত্রী গজেন্দ্র সিংহ শেখাওয়াতও ছুটলেন রাজনাথের বাড়ি। সকলে মিলে আগামিকাল মন্ত্রিসভায় রবি ফসলের সহায়ক মূল্য বৃদ্ধির আশ্বাস দিলেন। শেখাওয়াত নিজেও কৃষকদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কিন্তু খরচের ৫০ শতাংশ আর কৃষিঋণ মাফের দাবি মানলেন না। কৃষকরাও তাই রাতে ওখানেই বসে রইলেন। জল নেই, পর্যাপ্ত খাবার নেই। তবু ধর্না চলছে। পরিস্থিতি বুঝে গাজিয়াবাদে কাল স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অহিংসার দিনেই অন্নদাতাদের লাঠিপেটা! আজ মহারাষ্ট্রে ছিলেন রাহুল গাঁধী। সেখান থেকেই টুইট করলেন, ‘‘বিশ্ব অহিংসা দিবসে বিজেপির গাঁধী জয়ন্তী উদ্যাপন শুরুই হল শান্তিপূর্ণ ভাবে দিল্লিতে আসা কৃষকদের পিটিয়ে! এখন কৃষকরাও দেশের রাজধানীতে এসে নিজেদের যন্ত্রণা শোনাতে পারবেন না?’’ পরে জনসভায় বললেন, ‘‘১৫-২০ জন শিল্পপতির ৩ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মাফ করেন প্রধানমন্ত্রী। কৃষকদের বেলায় বলেন, নীতি নেই! আমরা আগেও মাফ করেছি, আবার করব। ব্যর্থ নরেন্দ্র মোদীকে ছেড়ে আমাদের ভরসা করুন।’’ ‘মোদীর কৃষক-বিরোধী অবস্থান আর নিষ্ঠুরতা’ নিয়ে কংগ্রেসের বিশেষ ওয়ার্কিং কমিটিতে একটি পৃথক প্রস্তাবও পাশ হল।
কংগ্রেস নেতা ভূপেন্দ্র সিংহ হুডাকে রাহুল নির্দেশ দিয়েছেন, অবিলম্বে প্রতিনিধি নিয়ে কৃষকদের পাশে দাঁড়ান। অর্থাৎ, কাল ফের উত্তাল হবে সীমানা। মোদী-মন্ত্রী শেখাওয়াতের দাবি, কৃষকরা বিক্ষোভ তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কৃষকরা অবশ্য তা বলছেন না। অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, কেজরীবাল থেকে সীতারাম ইয়েচুরি— কৃষকদের পাশে সকলেই। অন্য কৃষক সংগঠনও সমর্থনে নেমেছে। এমনকি মোদীর অস্বস্তি বাড়িয়ে বিশ্বস্ত শরিক নীতীশ কুমারের জেডিইউ-ও কৃষকদের উপর এই পুলিশি নির্যাতনের নিন্দা করেছে।
ভোটের আগে কৃষক-কাঁটা দূর করতে যোগী বললেন, মোদী বরাবর কৃষকদের সঙ্গে। ১৫ জন কৃষক আহত হওয়ার পরেও রাজনাথের দাবি, পুলিশ সংযমী ছিল। দিল্লি পুলিশও একই যুক্তি দিল। কিন্তু এখন সঙ্কটমুক্তির পথ খুঁজতে মরিয়া মোদীর সেনাপতিরা। রাতে ট্র্যাক্টরের মাথায় চেপে কৃষক ধর্মেন্দ্র মালিক বললেন, ‘‘এই বিজেপিই না কি হিন্দু সংস্কৃতির কথা বলে! দিল্লিতে আসা অতিথিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে বলছে, বাইরে থেকেই নিজের কথা বল!’’