কিকি-ঝড়ে বাদ যাননি তেলেঙ্গানার ই দুই কৃষক অনিল গিলা ও পিল্লি তিরুপতি (বাঁ দিকে )
‘কিকি চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে এখনও তোলপাড় গোটা বিশ্ব। ‘#kiki challenge’ লিখলেই প্রতি দিন সোশ্যাল সাইট ভেসে যাচ্ছে অগুনতি ‘অকুতোভয়’ মানুষের পোস্টে। তাদের বিপদের ছবিও ঘা মেরে যাচ্ছে আমাদের। ‘ব্লু হোয়েল’-এর পর আবারও এমন কোনও ওপেন চ্যালেঞ্জে গা ভাসাচ্ছে আমজনতা। এ উন্মত্ততায় বয়স বাধা মানে না। খাপ খায় না ধনী-দরিদ্র সমাজভেদ। যে ভাবেই হোক একখানা গাড়ি জোগাড় করেই এই বিপজ্জনক খেলায় মেতেছে আমজনতা।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশের তরফ থেকে এই ভয়ঙ্কর খেলা বন্ধ করতে এসেছে নির্দেশিকা। কলকাতা-সহ দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, লখনউ— সর্বত্রই পুলিশি প্রচারে উঠে এসেছে এর ভয়াল দিক। কখনও টুইট করে, কখনও বা বিজ্ঞাপনী প্রচারে মুখ খুলেছে প্রশাসন। কিন্তু তাতেও টনক নড়েনি জনগণের। গণমাধ্যমে জনতা জনার্দন হু হু করে ভাইরাল করে তুলেছে এই নয়া চ্যালেঞ্জকে।
কিকি চ্যালেঞ্জের বশবর্তী হয়ে নানা দুর্ঘটনার খবর প্রতি দিন যেমন খবরে উঠে এসেছে, ঠিক তেমনই তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কিকি চ্যালেঞ্জ স্বীকার করে সেই খেলায় অংশ নেওয়ার ছবি। ফলাও করে নিজেদের সোশ্যাল সাইটে তা ছড়িয়ে দিতেও ভোলেনি মানুষ।
আরও পড়ুন: হাল বলদ নিয়ে কিকি চ্যালেঞ্জে বাজিমাত তেলঙ্গানার দুই কৃষকের, ভাইরাল ভিডিয়ো
কিন্তু কেন এই আকর্ষণ? সে কি শুধুই নিষিদ্ধের প্রতি টান? না কি এর নেপথ্যে রয়েছে মানব মস্তিষ্কের আরও কিছু অজানা গলিঘুঁজি— যেখানে ঘাপটি মেরে থাকে নিরাপত্তাহীনতা, দুর্বলতার মতো আদিম অসুখ?
সে সবের খোঁজ নেওয়ার আগে আসুন দেখে নেওয়া যাক, কিকি চ্যালেঞ্জ কী, হঠাৎ কোথা থেকেই বা এর উৎপত্তি।
কিকি চ্যালেঞ্জ কী?
চলবে গাড়ি। ভিতরে বাজবে ইংরেজি গান। সেই অবস্থাতেই গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে নেমে গানের তালে নাচতে হবে। সোজা কথায় মূল চ্যালেঞ্জ এটাই। আর এখানেই থেকে যাচ্ছে দুর্ঘটনার প্রবল সম্ভাবনা। কানাডিয়ান হিপ হপ গায়ক ড্রেক-এর সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত গান ‘ইন মাই ফিলিংস’-এর উপর ভিত্তি করেই এই চ্যালেঞ্জ তৈরি।
আমেরিকান কমেডিয়ান শিগি ৩০ জুন তাঁর ইনস্টাগ্রামে প্রথম এই গানের উপর ভিত্তি করে নাচেন জনবহুল রাস্তায়। গানের একটি পঙক্তি ‘আর ইউ রাইডিং’-কে কেন্দ্র করেই এ বার জমাট হয় চ্যালেঞ্জের বহর। এই পঙ্ক্তির প্রভাবেই চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে নাচের চ্যালেঞ্জ শিগির নাচের ভিডিয়োটি শেয়ার করেন হলি-বলির নানা তারকা। সাধারণ জনগণও এর প্রভাব থেকে বাদ পড়েননি। সেলেবরা অংশগ্রহণ করতেই সোশ্যাল সাইটে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই নাচের ভিডিয়ো। নিমেষে হয়ে ওঠে ভাইরাল।
বেশ কিছু ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে যাঁরা এই চ্যালে়ঞ্জ নিচ্ছেন, তাঁরা চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে গানের তালে নেচে আবার ফিরছেন গাড়ির সিটে৷ গাড়িটিকে অবশ্যই চলন্ত অবস্থায় থাকতে হবে— এটাই প্রাথমিক শর্ত৷ এই চ্যালেঞ্জ একেবারেই নিরাপদ নয় বলেই মনে করছেন অধিকাংশ মানুষ৷ ইতিমধ্যেই গাড়ির ধাক্কায় াহত হয়েছেন অনেকেই। চলন্ত গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েও চোট-আঘাতের শিকার হয়েছেন অনেকেই।
আরও পড়ুন: ‘কিকি চ্যালেঞ্জ’ ছড়াচ্ছে নেটিজেনদের মধ্যে, বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন মনোবিদরা
মনোবিদদের মতে
কিকি চ্যালেঞ্জ নিয়ে বেশ বিরক্তই মনোবিদ অমিতাভ মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, সোশ্যাল সাইট আসলে মানুষের ভিতরে লুকিয়ে থাকা হুজুগে প্রবৃত্তিকে মাঝেমধ্যেই উসকে দেয়। এই জন্যই এ সব এত জনপ্রিয় হয়। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, আসলে মানুষ চারপাশের বিবিধ উপকরণ থেকে অবাক হতে বা উত্তেজিত হতে ভুলে গিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সোশ্যাল সাইটে চলে বহমান সমান্তরাল একটি সমাজ। যে সমাজে মানুষ খুব দেখানেপনার শিকার। সারা ক্ষণ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে খুব জনপ্রিয় কিছুতে অংশ নেওয়াই তার লক্ষ্য। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থেকে তো নয়ই, বরং, মানসিক দুর্বলতা থাকলে তবেই এ সব ফাঁদে পা দেন মানুষ।
পরিত্রাণের উপায়
অমিতাভবাবুর মতে, খুব বেশি সোশ্যাল সাইট নির্ভর জীবন না বেছে একটু চারপাশের মানুষজন, প্রকৃতি এদের মধ্যে সন্তানকে বেড়ে উঠতে দিন। নিজের জগৎ সাজিয়ে তুলুন এ সব দিয়েই। তাতে এ ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার খিদে কমবে। অনুত্তমাও জোর দিচ্ছেন এই একই দিকে। সোশ্যাল সাইটের সমান্তরাল সমাজ থেকে চোখ সরিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে যে আরাম আছে, তা নজরে না আনলে এমন হুজুগ কাটবে না বলেই তাঁর অভিমত।