মহাটক্করের দিন গোনা শুরু বিহারে

এই নির্বাচনকে বলা হচ্ছে দেশের অন্যতম দিক-নির্দেশক। জাতীয় রাজনীতি এবং পরবর্তী বিধানসভা ভোটগুলির উপরে এর কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে সর্বত্র। সেই বিহার ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হল আজ।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত ও দিবাকর রায়

নয়াদিল্লি ও পটনা শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩১
Share:

অগ্নিপরীক্ষা যাঁদের। ভোট ঘোষণার দিন নীতীশ কুমার ও লালু প্রসাদ। বুধবার পটনায়। ছবি: পিটিআই।

এই নির্বাচনকে বলা হচ্ছে দেশের অন্যতম দিক-নির্দেশক। জাতীয় রাজনীতি এবং পরবর্তী বিধানসভা ভোটগুলির উপরে এর কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে সর্বত্র। সেই বিহার ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হল আজ। আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিক্ষা নিয়ে এই ভোট-পর্বের যাবতীয় রাশ নিজেদের হাতে রাখার সিদ্ধান্ত নিল নির্বাচন কমিশন।

Advertisement

পাঁচ দফার এই নির্বাচন শুরু হচ্ছে ১২ অক্টোবর। শেষ হবে ৫ নভেম্বর। আর গণনা ৮ নভেম্বর। প্রায় তিন সপ্তাহের এই পর্বের মধ্যে পড়বে বিজয়া দশমী তথা দশেরা। আর দিওয়ালির তিন দিন আগে ফল প্রকাশ। ১১ তারিখ কাদের ঘর আলো থাকবে আর কাদের অন্ধকার, সেটাই সব থেকে বড় প্রশ্ন। দিল্লির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, যে ভাবে নিজেদের মধ্যে টক্করটা তুঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকুমার, তাতে বোঝা যাচ্ছে, এই ভোটের গুরুত্ব কতখানি।

গুরুত্বের কথা অস্বীকার করছেন না বিজেপি নেতৃত্বও। কিন্তু, ২৪৩ আসনের একটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের এত গুরুত্ব কেন? বিজেপি সূত্রের মতে, দলের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখতে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির কাছে বিহার ভোট কার্যত মরণ-বাঁচন লড়াই। বিহার ভোটে হেরে গেলে অমিত শাহ তো ছাড়, দলের মধ্যে মোদীর নেতৃত্বও না চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে! এর পরে রয়েছে একাধিক রাজ্যে বিধানসভা ভোট। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, কেরল, তামিলনাড়ু ও পুদুচেরি। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ। এর মধ্যে অসমের ব্যপারে তো যথেষ্ট আশাবাদী বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গেও তারা এ বারে আগের থেকে ভাল ফল করবে বলে বিশ্বাস রয়েছে দলের। উত্তর প্রদেশেও ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না দলীয় নেতৃত্ব। কিন্তু এ সবের জন্য প্রয়োজন সেই মোদীর, লোকসভা ভোটে যিনি মুলায়মের রাজ্য থেকে ৮০টির মধ্যে ৭৩টি আসনে জিতিয়ে এনেছিলেন এনডিএ-কে, এবং নীতীশের রাজ্য থেকে ৪০-এর মধ্যে ৩১টিতে।

Advertisement

নীতীশ-লালুর কাছেও এই ভোট সব কিছু বাজি রাখার লড়াই। ভোটে হারলে আগামী পাঁচ বছর দলের ‘সাইনবোর্ড’ ছাড়া আর যে দু’জনের হাতে আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকবে না, সে ব্যাপারে একমত রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা। বিশেষ করে নীতীশের। কারণ, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর যাবতীয় রাজনৈতিক সম্মান।

টক্করটা কোথায় পৌঁছচ্ছে, সেটাও এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন দুই নেতৃত্ব। সকালে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নাসিম জাইদির ডাকা সাংবাদিক বৈঠকের খবর চাউর হতেই তৈরি হয় দু’পক্ষ। বিকেলে নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণার ঘণ্টাখানেক আগে মোদী মন্ত্রিসভা সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী-অফিসারদের ৬ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করে। তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই পটনায় নীতীশ মন্ত্রিসভাও একই হারে রাজ্য সরকারি কর্মীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অবশ্য একই সঙ্গে বিহার প্যাকেজে বিদ্যুৎ খাতে আরও ১৮৫০ কোটি টাকা যোগ করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে।

এই নাটকীয় পরিস্থিতির মধ্যে যে নির্বাচন, তাতে কোনও রকম ফাঁক রাখতে নারাজ নির্বাচন কমিশন। দিল্লি সূত্রে বলা হচ্ছে, মোদীর সম্মান যেখানে জড়িত, সেখানে বিজেপি ধাক্কা খাক, এমনটা কেন্দ্রীয় সরকারই চাইবে না। কমিশন যে ভাবে আজ থেকেই আঁটোসাঁটো মনোভাব নেওয়ার ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে, তার পিছনে কেন্দ্রের প্রভাব থাকার সম্ভাবনা তাই উড়িয়ে দিচ্ছে না রাজনীতির অনেকেই।

কমিশনের এত কড়াকড়ির পিছনে অবশ্য অন্য কারণও রয়েছে। তারা ঘরোয়া মহলে স্বীকার করছে, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই এ বার এত কড়াকড়ি। বিশেষ করে, গত লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা কমিশনের কাছে এখনও টাটকা। ওই নির্বাচনে মমতা প্রশাসন আধা-সামরিক বাহিনীকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল বলে অভিযোগ। ফলে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়। তাই এ বার সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাইছে না কমিশন।

পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা ভোটের দায়িত্বে থাকা কমিশনের এক কর্তার উপলব্ধি, ‘‘চাহিদা মতো নিরাপত্তারক্ষী থাকা সত্ত্বেও, শাসক দলকে সুবিধা পাইয়ে দিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রাখার অভিযোগ ওঠে রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এমন জায়গায় ওই বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়, যা তুলনায় নিরুপদ্রব অঞ্চল।’’ তাঁর বক্তব্য, স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যের উপরে নির্ভর করার ফলেই তাঁদের ‘ঠকতে’ হয়েছে। এমনকী, পশ্চিমবঙ্গে যে নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরা গিয়েছিলেন, তাঁদেরও প্রভাবিত করার অভিযোগ ওঠে শাসক দলের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের পরে সেই রিপোর্ট জমা পড়ে কমিশনের কাছে। তার পরেই নড়েচড়ে বসে কমিশন। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বিশ্লেষণ করে কমিশন ঠিক করে, আগামী দিনে যে কোনও নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে রাশটা পুরোপুরি নিজেদের হাতে রাখবে। স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা একেবারেই সীমিত গণ্ডির মধ্যে রাখা হবে, যাতে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন না উঠতে পারে।

আসন্ন নির্বাচনে তাই কয়েকটি বিষয়ের উপরে বেশি জোর দেবে কমিশন। প্রথমত, ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে পুলিশ পর্যবেক্ষকদের। তাঁরা কার্যত প্রতিটি জেলায় এসপি-দের মাথার উপরে থাকবেন। এই কাজে মূলত অন্য রাজ্যের আইপিএস ও আমলাদের নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। তাঁরাই সংশ্লিষ্ট এলাকার সংবেদনশীলতার নিরিখে কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে বুথভিত্তিক আধা-সামরিক বাহিনী নিয়োগ করবেন। দ্বিতীয়ত, বিহারে ‘পেড নিউজের’ ঘটনা আকছারই ঘটে বলে অভিযোগ। তাই রাজ্যের সিইও-কে সতর্ক করে দেওয়ার পাশাপাশি, সংবাদমাধ্যমের উপর বিশেষ নজরদারি চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তৃতীয়ত, নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মচারীদের উপরেও কমিশন নিরন্তর নজরদারি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমিশনের বক্তব্য, সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই কর্মীদের অজান্তেই তাঁদের উপর নজরদারি চালানো হবে।

বিহারের বেলায় কমিশন যে অতিরিক্ত সতর্ক, তার আর এক বড় কারণ রাজ্যে মাওবাদী প্রভাব। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। নীতীশ অবশ্য ভোট ঘোষণার পরেই বলেছেন, ‘‘আমরাও চাই স্বচ্ছ নির্বাচন হোক। আর তার জন্য কমিশনকে সাহায্য করতে আমরাও প্রস্তুত।’’

পাঁচ দফার নির্বাচন এবং প্রতিটি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন নীতীশ। স্বাগত জানিয়েছে বিজেপি এবং এনডিএ-র জোট সঙ্গীরাও। আরজেডি অবশ্য প্রথম থেকেই এক দফায় নির্বাচন করানোর দাবি করে আসছিল। আরজেডি-প্রধান লালু বলেন, ‘‘এক দফায় নির্বাচন হলে ভাল হতো।’’

আর নীতীশ? তিনি এ দিন নিজের মেজাজেই ছিলেন। এক দিকে হুঙ্কার দিয়েছেন, ‘‘হমলোগ তৈয়ার হ্যায়। উনলোগোকো আনে দিজিয়ে।’’ অন্য দিকে আবার রসিকতার ঢঙে বলেছেন, ‘‘নির্বাচনে জেতা-হারা নিয়ে ভাবি না। প্রচারের জন্য ৩৮ দিন সময় রয়েছে। এর মধ্যেই আমি বিজয়া দশমী-দীপাবলি পালন করব।’’
এক সময় তাঁর জোট সঙ্গী, প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী সুশীলকুমার মোদী অবশ্য খোঁচা দিতে ছাড়েননি, ‘‘শাসক দলের লোকেরা বুঝতে পারছেন পরাজয় আসন্ন। তাই এ সব বলছেন।’’

দিওয়ালিতে কাদের ঘরে দীপ জ্বলবে, তারই কাউন্টডাউন আজ থেকে শুরু হয়ে গেল বিহারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন