নবকলেবরের টানে ন’মাস ঘরছাড়া লিজা-রোলান্ডরা

ক’দিন ধরেই এ তল্লাটে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। কুর্তি-লেগিংসের সঙ্গে পুঁচকে লাল টিপে বেশ মানিয়েছে নীল চোখের মেমসাহেবকে। রথের আশপাশে ঘুরতে ঘুরতে ব্যাগ থেকে ট্যাব বার করে কী সব যেন টুকে নিচ্ছেন।

Advertisement

ঋজু বসু

পুরী শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৫ ০৩:০৫
Share:

ক’দিন ধরেই এ তল্লাটে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে।

Advertisement

কুর্তি-লেগিংসের সঙ্গে পুঁচকে লাল টিপে বেশ মানিয়েছে নীল চোখের মেমসাহেবকে। রথের আশপাশে ঘুরতে ঘুরতে ব্যাগ থেকে ট্যাব বার করে কী সব যেন টুকে নিচ্ছেন।

গুন্ডিচা মন্দিরের সামনের রাস্তা, সরদাবালুতে জগন্নাথের রথের ব্যারিকেড থেকে একটু দূরে সোম-দুপুরে ফের দেখা গেল তাঁকে। সঙ্গে খয়েরি দাড়ির পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক টকটকে ফর্সা যুবক। এমনিতে শ্বেতাঙ্গ ভক্তের অভাব নেই জগন্নাথদেবের। টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে ক’দিন ধরেই তাঁরা প্রভুর নামে উদ্বাহু জয়ধ্বনি দিচ্ছেন। কিন্তু এই দু’জনের কেউই ক্যামেরার সামনে ‘পোজ’ দিতে রাজি হলেন না।

Advertisement

ভক্ত না পর্যটক? কী উদ্দেশ্যে আসা হয়েছে জগন্নাথধামে? আলাপ করতে যেতেই তরুণী হাসেন, ‘‘দু’টোর কোনওটাই নয়। অন্য কাজে এখানে এসেছি,’’ বললেন লিজা জল্‌ফ নামের সেই নীল নয়না। সঙ্গী যুবকের নাম রোলান্ড হাডেনবার্গ। জার্মানির টুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য চর্চার একটি প্রকল্পের জন্য ওঁদের গোটা একটা দল, নবকলেবরের নাড়ি-নক্ষত্র বুঝতে ন’মাস ধরে পুরীতে পড়ে। সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের কয়েক জন গবেষক ছাত্রছাত্রী লিজাদের সাহায্য করছেন।

ভক্তি বা নিছক বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের বাইরে এ-ও এক জগন্নাথ-সন্ধান। ভক্তেরা থাকা-খাওয়ার পরোয়া না করে প্রভুর ইচ্ছায় ভর দিয়ে রথ দেখতে উদ্বেল। আবার কিছু সম্পন্ন বিদেশি পর্যটকের হদিস মিলল, যাঁরা সাত দিনে দু’ থেকে আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ করে রথযাত্রার গোটা প্যাকেজ উপভোগে সামিল। সাবেক মন্দির ছেড়ে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার ‘ছুটি’র ঠিকানা গুন্ডিচামন্দিরের দিকটাতেই ভিড় তাঁদের।

তবে অন্য তাগিদেও কেউ কেউ এই অমানুষিক ভিড় আর দাবদাহের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই সাবেক শহরের কোর্টপাড়া কাছারি মোড়ে জেলার জনসংযোগ আধিকারিকের অফিসে তেমনই এক জনের দেখা মিলল। আইআইটি খড়গপুরের স্থাপত্যবিদ্যা ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিষয়ক দফতরের শিক্ষক সুমনা গুপ্ত বললেন, ‘‘প্রজেক্টের কাজ না-থাকলে এই ভিড়ে আসতাম বলে মনে হয় না।’’ ভারতবর্ষে এ ধরনের বিরাট উত্সবে পরিকাঠামো-পরিকল্পনার খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখতেই তিনি এসেছেন। দিল্লির ‘কালচারাল রিসোর্স কনজারভেশন ইনিশিয়েটিভ’-এর অধিকর্তা তথা কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের উপদেষ্টা গুরমিত রাইও উত্সবের পুরীর চেহারা দেখতে এসেছেন প্রধানত পেশাগত তাগিদেই। তবে গুরমিত আসছেন শুনে, তাঁর সত্তরোর্ধ্ব স্বামী রঘু রাইও ক্যামেরা ঘাড়ে চলে এসেছেন। ছাদ থেকে রাজপথে ছবির জন্য ওঠা-নামার ফাঁকে জল খেতে খেতে রঘু বললেন, ‘‘এই প্রথম পুরীর রথের ছবি তুলতে এলাম।’’ ওড়িশার ভূমিপুত্র, চিত্রশিল্পী যতীন দাশও চল্লিশ বছর বাদে এ বার পুরীর রথ দেখতে এলেন। এই আসা কি নবকলেবরের মহিমায়? যতীন হেসে বলেন, ‘‘ধর্ম নয়, পরম্পরার প্রতি আকর্ষণেই চলে এলাম।’’

নিজেরা ছকে বাঁধা ধার্মিক নন। তবু রথ ঘিরে মানুষের অক্লান্ত সহ্যশক্তি ও শ্রদ্ধাভাবকে কুর্নিশ করছিলেন যতীন-গুরমিতরা। ‘‘ভিতরে আনন্দের অনুভব ছাড়া এই ধকল সম্ভব নয়,’’ বলভদ্র-সুভদ্রা-জগন্নাথদেবের রথারোহণ বা ‘পহুন্ডি’র সময় চড়া রোদে চার ঘণ্টা নাগাড়ে নাচে-গানে-বাজনায় বিভোর শিল্পীদের প্রসঙ্গে বলছিলেন গুরমিত। আর যতীনের উপলব্ধি, ‘‘নতুন করে বুঝলাম, আমাদের দেশ চাইলে কী না করতে পারে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন