যাবতীয় নথি হাতে নিয়েও মাথায় হাত প্রদীপ-মিতালির। ছবি: স্বপন রায়।
শিলচরের বিজেপি বিধায়ক দিলীপকুমার পাল কি বাংলাদেশি? না, প্রশ্নটা এভাবে উত্থাপন করেননি কেউ। তবে শিলচরের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল তাঁর ছোট ভাই প্রদীপ পাল ও ভ্রাতৃবধূ মিতালি পালের নামে সমন জারি করেছে। ৩০ জুলাই নথিপত্র নিয়ে তাঁদের আদালতে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা যে প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক, প্রমাণ চেয়েছে ট্রাইব্যুনাল। সমন পেয়ে বিস্মিত পাল পরিবারের সদস্যরা। দিলীপবাবুর সন্দেহ, এর পিছনে বড়সড় ষড়যন্ত্র রয়েছে। নইলে বাবা শচীন্দ্র পালের ১৯৫১ সালের শরণার্থীর শংসাপত্র, ১৯৫৬ সালের জেলাশাসক স্বাক্ষরিত গৃহনির্মাণের ঋণমঞ্জুরি, মা-বাবার পাসপোর্ট, প্রদীপবাবুর নিজের পাসপোর্ট থাকার পরেও কী করে তাঁকে বিদেশি বলে সন্দেহ করা হয়? প্রদীপবাবুর স্ত্রী মিতালিদেবীরও প্রশ্ন, তাঁর বাবার ১৯৫৬ সালে ইস্যু করা সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট রয়েছে। আর কী নথি চাই আদালতের?
বঙ্গভাষীদের এমন হয়রানির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে শিলচরের বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন। তারা পুলিশের বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগ আনেন। বলেন, কাগজপত্র পরীক্ষা না করে পুলিশ যাকে-তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনালে রিপোর্ট পাঠায়। এর জেরে প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের কাগজপত্র নিয়ে দিনের পর দিন অহেতুক আদালতে ছোটাছুটি করতে হয়।
কাছাড়ের পুলিশ সুপার দিগন্ত বরা জানান, ট্রাইব্যুনালের নোটিশ পাঠানোর দু’টি প্রক্রিয়া রয়েছে। কেউ কাউকে বিদেশি সন্দেহ করে পুলিশকে অভিযোগ জানালে পুলিশ অভিযুক্তের বাড়িতে ফিল্ড লেভেল অফিসার পাঠায়। অভিযুক্ত তাঁকে কাগজপত্র দেখিয়ে সন্তুষ্ট করতে না পারলে ট্রাইব্যুনালে রিপোর্ট পাঠানো হয়। ট্রাইব্যুনাল তখন তাঁর নামে নোটিশ পাঠায়। দ্বিতীয়ত, ১৯৯৭ সাল থেকে ভোটার তালিকা দেখে সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করা হয়। এই কাজটি করে নির্বাচন শাখা নিযুক্ত বুথ লেভেল অফিসাররা। তাঁরা জেলা নির্বাচন অফিসারকে তাঁদের সন্দেহের কথা জানায়। নির্বাচন অফিসার জানান ট্রাইব্যুনালকে। সে ক্ষেত্রে ভোটার তালিকায় সন্দেহভাজনের নামের পাশে ‘ডি’ চিহ্ন বসানো হয়—ডাউটফুল। প্রদীপবাবু ও তাঁর পত্নীর ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টিই ঘটেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার বরা। সে জায়গায় পুলিশের কোনও ভূমিকা নেই বলেই তিনি দাবি করেন।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রদীপবাবুর বিরুদ্ধে ডি-ভোটার সংক্রান্ত মামলা রয়েছে। ১৯৯৭ সালে প্রথম যখন এক সঙ্গে প্রচুর ডি-ভোটার চিহ্নিত হয়েছিল, প্রদীপবাবুর নাম তখন ওই তালিকাতেই ছিল। কখনও বিচারকের অভাব, কখনও কর্মীর অভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগটি ২০১১ সালে ট্রাইব্যুনালে নথিভুক্ত হয়। এর পর পাল দম্পতির বিরুদ্ধে সমন জারি হয়। লেখা ছিল, প্রদীপ পাল, পিতা শচীন্দ্র পাল, মালিনিবিল, শিলচর। মালতীদেবীরও ওই একই ঠিকানা। মালিনিবিলে গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি বলেই উল্লেখ রয়েছে ট্রাইব্যুনালের নথিতে। এ বার আবার ওই সমনের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণের সময় এলে ট্রাইব্যুনাল ফের লোক পাঠায়। আশ্রম রোডে সন্ধান মেলে শচীন্দ্র পালের পুত্র প্রদীপবাবু এবং পুত্রবধূ মালতীদেবীর। তবে ঠিকানা লেখা রয়েছে, সেই মালিনিবিল।
প্রদীপবাবু জানান, ট্রাইব্যুনাল থেকে কোনও দিন কেউ তাঁর কাছে যায়নি। এ ছাড়া, ডি ভোটার চিহ্নিত হলে ভোটার তালিকার নামের পাশে ‘ডি’ লেখা থাকে। মামলার চূড়ান্ত ফয়সলা না হওয়া পর্যন্ত তাঁর ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে কোনওটিই হয়নি। তিনি নিয়মিত ভোট দিচ্ছেন। কখনও ভোটার তালিকায় তাঁর বা তাঁর স্ত্রীর নামের পাশে ‘ডি’ লেখা হয়নি। এমনকী ২০০৪ সালে নির্বাচন শাখা থেকে তাঁকে ভোটার প্রমাণপত্র (সার্টিফায়েড কপি) দিয়েছে। গত বছর দিয়েছে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র। তাঁর জিজ্ঞাস্য, ১৯৯৯ সাল থেকে তাঁর নিজের নামে পাসপোর্ট রয়েছে। তখন কি পুলিশ খোঁজখবর নেয়নি? একজন সন্দেহভাজনকে কি করে পাসপোর্ট ইস্যুর জন্য শংসাপত্র দেওয়া হয়?
তিনি এর পিছনে অন্য ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেই মনে করছেন। বিশেষ করে এনআরসি নিয়ে মানুষ যখন প্রবল উত্কণ্ঠায়, ঠিক সেই সময়ে বিধায়কের ভাইয়ের নামে নোটিশের পিছনে কোনও অভিসন্ধি কাজ করছে। দিলীপবাবু বলেন, ‘‘আমি বিষয়টির শেষ দেখে ছাড়ব। এই নোটিশে আমরা পুরো পরিবার অপমানিত বোধ করছি। প্রদীপ-মালতী সমস্ত নথি নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে আদালতে যাবে। পরে আইনি প্রক্রিয়াতেই এই অপমানের বিচার চাইব।’’
তিনি অবশ্য গত কালই গুয়াহাটির দলীয় বৈঠকে সমনের কপি বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের হাতে তুলে দেন। অমিত শাহ কাল গুয়াহাটিতে দলীয় বিধায়কদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনিই জানতে চেয়েছিলেন, হিন্দুরা এখন কেমন আছে। দিলীপবাবু তখন ওই সমনের কপি তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘বাঙালি হিন্দুরা মোটেও ভাল নেই। যাকে-তাকে বাংলাদেশি বলা হচ্ছে। এনআরসি নিয়েও আতঙ্কে সাধারণ মানুষ।’’ ধর্মীয় নির্যাতনের দরুন এদেশে এসে বসবাসকারীদের সবাইকে নাগরিকত্ব প্রদানে দলের প্রতিশ্রুতির কথা অমিত শাহকে স্মরণ করিয়ে দেন দিলীপবাবু। দিলীপবাবু জানান, বিজেপি সরকার এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে বলে সর্বভারতীয় সভাপতি কালও তাঁকে কথা দিয়েছেন।
বিদেশি বলে অভিযুক্ত প্রদীপবাবু শুধু দিলীপ পালের ভাই-ই নন, তিনি শিলচর শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সংস্কৃতিকর্মী হিসেবেও বেশ পরিচিতি তাঁর। নিজের ঘরে নথিপত্রের বিশাল ফাইল থেকে একের পর এক নথি দেখিয়ে প্রদীপবাবু জানান, ১৯৫০ সালে বাবা প্রথম এ দেশে আসেন। ১৯৫১ সালে শরণার্থী শংসা পত্র দেওয়া হয়। ১৯৫৫ সালে মা উজ্জলাবালা পাল পাসপোর্ট করে বাংলাদেশ ঘুরে আসেন। সেই পাসপোর্টে তাঁর তিন শিশুসন্তানের নামও উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে দিলীপ পালের নামও রয়েছে। প্রদীপবাবুর তখনও জন্ম হয়নি। ১৯৫৬ সালে কাছাড়ের জেলাশাসক বাড়িঘর তৈরির জন্য শরণার্থীদের ঋণ মঞ্জুর করেন। ৫ এপ্রিল তাঁর বাবার নামে ইস্যু করা সেই মঞ্জুরিপত্রও রয়েছে প্রদীপবাবুর ফাইলে। ১৯৬৮ সালে শিলচরে জমি কেনেন তাঁরা। সেই জমিতে বাড়ি তৈরির জন্য ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মা উজ্জলাবালা পাল শিলচর পুরসভায় আবেদন করেছিলেন। ১ মার্চ সেই অনুমতি দেন তখনকার উপ-সভাপতি পুষ্পরঞ্জন গুপ্ত। বাবা শচীন্দ্র পালের পাসপোর্ট ইস্যু হয় ১৯৭৭ সালের ১২ মার্চ। তাতে সন্তানের কলামে রয়েছে দিলীপবাবু, প্রদীপবাবুরও নাম। ১৯৮৫ সালের ৩০ নভেম্বর জেলাশাসকের কার্যালয় থেকে প্রদীপবাবুকে স্থায়ী নাগরিকত্বের শংসাপত্র দেওয়া হয়। এনআরসি-র কথায় যে বিষয়টিতে এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সেটি হল বাবা কিংবা মায়ের লিগ্যাসি ডেটা অর্থাত্ বংশপঞ্জির সন্ধানসূচক নম্বর। বাবা-মা দু’জনের লিগ্যাসি ডেটাই রয়েছে প্রদীপবাবুর ফাইলে। বাবার নম্বর ৩১০-৪০৩৩-৬৩৯২। মায়ের ৩১০-২০৬৭-৭৮০১। প্রদীপবাবুর পড়াশোনা প্রথমে ক্ষীরোদশশী পাঠশালায়। পরে অধরচাঁদ স্কুল, কাছাড় কলেজে। থরে থরে সাজানো রয়েছে সে সব কাগজপত্র।
মিতালি পালের হাতে রয়েছে বাবা প্রভাতচন্দ্র রায়ের সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট। তাও ১৯৫৬ সালের ২৩ অক্টোবর ইস্যু করা। শিলচর শহরে পদ্মনগরের আদি বাসিন্দা তাঁরা। এখনও সেখানেই থাকেন তাঁর ভাইরা। ১৯৮৬ সালে শিলচর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। রয়েছে সেই অ্যাডমিট কার্ডও।
পাল দম্পতির আক্ষেপ, বাংলাদেশি বলে সন্দেহ হওয়ার পর পরই যদি কাগজপত্র নিয়ে তাঁদের হাজির হতে বলা হতো তবে অন্তত সমন জারি করতে হত না।