আশ্বাস দিলেন সবার প্রধানমন্ত্রী

কড়া অবস্থান না বদলেও প্রলেপ মারধরের ক্ষতে

বিরোধীরা আক্রমণ শানাতে পারেন, শিক্ষাজগত প্রতিবাদে সরব হতে পারে। কিন্তু জেএনইউ-এর ঘটনা নিয়ে কোনও মতেই মুঠো আলগা করতে চায় না কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ, জাতীয়তাবাদী আবেগে সওয়ার হলে রাজনৈতিক ফায়দা হবে বলেই আত্মবিশ্বাসী বিজেপি। কিন্তু গত কাল পাটিয়ালা হাউস কোর্ট চত্বরে মারামারি এবং তাতে শাসক দলের ভূমিকা যে তাতে খানিকটা চোনা ফেলেছে, সেটাও অস্বীকার করতে পারছে না তারা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫৭
Share:

পাশে আছি। জেএনইউয়ের প্রতিবাদের সমর্থনে মিছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের। মঙ্গলবার শশাঙ্ক মণ্ডলের তোলা ছবি।

বিরোধীরা আক্রমণ শানাতে পারেন, শিক্ষাজগত প্রতিবাদে সরব হতে পারে। কিন্তু জেএনইউ-এর ঘটনা নিয়ে কোনও মতেই মুঠো আলগা করতে চায় না কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ, জাতীয়তাবাদী আবেগে সওয়ার হলে রাজনৈতিক ফায়দা হবে বলেই আত্মবিশ্বাসী বিজেপি। কিন্তু গত কাল পাটিয়ালা হাউস কোর্ট চত্বরে মারামারি এবং তাতে শাসক দলের ভূমিকা যে তাতে খানিকটা চোনা ফেলেছে, সেটাও অস্বীকার করতে পারছে না তারা।

Advertisement

এই আবহে মঙ্গলবার সর্বদল বৈঠকে বিরোধীদের মুখোমুখি হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। খানিকটা ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার মতো করেই বললেন, ‘‘আমি বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নই, সকলের প্রধানমন্ত্রী।’’

দাদরি থেকে হায়দরাবাদ— সাম্প্রতিক অতীতে একের পর এক ঘটনায় মুখ পুড়েছে সরকারের। বিরোধীরা সেই পরম্পরাতেই জেএনইউ-কে রেখে ফের সেই অসহিষ্ণুতার অভিযোগ তুলছেন। কিন্তু বিজেপি মনে করে, দাদরির ঘটনা বা রোহিত ভেমুলার মৃত্যুর সঙ্গে জেএনইউ-এর ঘটনার তুলনা চলে না। এখানে দেশের ঐক্য, অখণ্ডতা, সন্ত্রাসবাদ এবং সার্বিক ভাবে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি জড়িত। সেই কারণেই দলীয় নেতৃত্বের মতে, দাদরি বা রোহিতের ঘটনায় তাঁরা যে ভাবে ব্যাকফুটে ছিলেন, জেএনইউ-তে তা নন। বরং এই সুযোগে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রচার করে নিজেদের পায়ের মাটি অনেকটাই শক্ত করে নেওয়া যাবে। গত রবিবারই প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, গোটা দেশ জুড়ে জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলবে দল। সংসদ অধিবেশনের ঠিক আগে ১৮ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক ভাবে পাল্টা প্রচার চালানো হবে। আর সরকারি স্তরে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় কোনও রকম রাশ আলগা করা হবে না। দেশপ্রেমের প্রশ্নে সরকার যে কাউকে রেয়াত করে না, এই ছবিটাই বরং বেশি করে তুলে ধরা হবে। আমজনতার আবেগ তাতেই সাড়া দেবে, এমনটাই আশা করেন তাঁরা।

Advertisement

পরিকল্পনা অনুযায়ী সব ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল। কিন্তু গত কালের মারধরের ঘটনা একটু হলেও অস্বস্তি তৈরি করে দিল। সোমবার পাটিয়ালা হাউস কোর্ট চত্বরে দিল্লির বিজেপি বিধায়ক ও পি শর্মাকে মারমুখী অবস্থায় পরিষ্কার দেখা গিয়েছে ক্যামেরায়। অভিযোগ রয়েছে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তারও। এর প্রতিবাদে আজ সাংবাদিকরা মিছিল করেন দিল্লির রাজপথে। তাঁদের একটি দল দেখা করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে। অন্য দলটি দ্বারস্থ হয় সুপ্রিম কোর্টের। দু’পক্ষের কাছেই দোষীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে শাস্তির দাবি জানানো হয়। সুপ্রিম কোর্ট আবেদনটি গ্রহণ করেছে। বুধবার শুনানি হবে। সরকারের তরফেও ঘটনাটি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আজ অবশ্য সারা দিনে কাউকে গ্রেফতার করে উঠতে পারেনি তারা। কিন্তু দিল্লির পুলিশ কমিশনার বি এস বাসসি দাবি করেছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা গাফিলতির অভিযোগ গুরুত্ব দিয়েই দেখা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই রকম একটি ঘটনায় দলের নাম জড়িয়ে না-গেলে আরও উজ্জীবিত হয়ে মাঠে নামা যেত বলে মনে করছেন মোদীরা।

এই পরিস্থিতিতে আজ সর্বদলীয় বৈঠকটি দু’ভাবে কাজে লাগাতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এক দিকে বিরোধীদের উষ্মা-ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টায় কিছুটা তৎপর হয়ে তিনি বোঝাতে চাইলেন, সরকার একদেশদর্শী নয়। বিরোধীদের কথাও তাঁরা সমান ভাবে শোনেন। অন্য দিকে, সংসদের আসন্ন অধিবেশনটি যাতে বিরোধীরা কিছুটা মসৃণ ভাবে চলতে দেন, সেটার জন্যও সওয়াল করলেন। ২৩ তারিখ থেকে শুরু হতে চলেছে বাজেট অধিবেশন। এর আগে দু’টি অধিবেশনই প্রায় ভেস্তে গিয়েছে। এক বার ললিত মোদী বিতর্ক আর পরের বার অসহিষ্ণুতা এবং ন্যাশনাল হেরাল্ড বিতর্কে উত্তাল হয়ে ওঠে সংসদ। থমকে যায় সংস্কার কর্মসূচি। তাই নিয়ে শিল্পমহল যেমন ইতিমধ্যেই তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে, সরকারের নিজের কাছেও তার নাজেহাল ভাবমূর্তি শুধরে নেওয়ার দায় রয়েছে। আজ তাই মোদী সরাসরি বলেন, তিনি আশা করেন, বিরোধীরা আসন্ন অধিবেশনটি চলতে দেবেন। বিরোধীরা এর উত্তরে একযোগে জানিয়ে দেন, সংসদে তাঁরা জেএনইউ, রোহিত ভেমুলা, অরুণাচল সংকটের মতো সব বিষয়ই তুলতে চান। তাঁরা বলেন, ‘‘সাংবিধানিক পদাধিকারীরা যদি দেশের পরিবেশ বিষিয়ে তোলেন, তা হলে তার আঁচ সংসদে পড়বেই!’’ উত্তরে মোদী তাঁদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলেন, ‘‘বিরোধীদের তোলা সব বিষয়েই আমরা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করব।’’ লক্ষ্য স্পষ্ট, এর পরেও সংসদ অচল হলে তার দায় বিরোধীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া।

সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু বিরোধীদের প্রশ্ন করেন, কী ভাবে তাঁরা জাতীয়তা-বিরোধী মনোভাবকে সহ্য করছেন? কংগ্রেস-সহ অন্য দলগুলির পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, তাঁরা কখনওই দেশ-বিরোধী কোনও কাজে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু সরকারেরও কিছুটা সংযত থাকা দরকার। সরকার যদিও জেএনইউ মামলায় এখনই নরম হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখাচ্ছে না। জেএনইউ তদন্তে এনআইএ-কে সামিল করতে চেয়ে এ দিন হাইকোর্টে আবেদন করে পুলিশ। হাইকোর্ট অবশ্য তা খারিজ করেছে। অন্য দিকে কাল রাতেই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক এস এ আর গিলানিকে আটক করেছিল পুলিশ। আজ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সংসদ হামলার ঘটনায় এক সময়কার অভিযুক্ত গিলানি গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রেস ক্লাবে আফজল গুরুর সমর্থনে একটি অনুষ্ঠান করেন বলে অভিযোগ। ৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জেএনইউ-এর অনুষ্ঠানেও তাঁর সমর্থন ছিল বলে সরকারের দাবি।

জেএনইউ-এ পুলিশের তালিকায় রয়েছে সিপিআই সাংসদ ডি রাজার মেয়ে অপরাজিতা রাজার নাম। আজ অরুণ জেটলির সঙ্গে দেখা করে এ নিয়ে কথা বলেন রাজা ও সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম। জেটলি প্রস্তাব দেন, অপরাজিতা যেন মুচলেকা দিয়ে জানান যে তিনি দেশ-বিরোধী স্লোগান দেননি। রাজা বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ কারাট ও সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে নিয়ে আলোচনা করেন। তখন ঠিক হয়, শাসক শিবিরের ফাঁদে পা দেওয়া হবে না। জেএনইউতে যে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, তাতে চিড় ধরানো চলবে না। আজও ধর্মঘটের কারণে ক্লাস বন্ধ ছিল জেএনইউতে। ছাত্রদের ধর্মঘটে আজ যোগ দেন শিক্ষকরাও।

আজকের বৈঠকে তৃণমূল বাদে অধিকাংশ দল জেএনইউ-এর ঘটনার নিন্দা করে। কানহাইয়াকে দেশদ্রোহী বলা যায় না দাবি করেন বিরোধীরা। তার মধ্যেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের টুইট, ‘‘জেএনইউয়ের ঘটনায় তৃণমূলের নীরবতা দেখাচ্ছে, বিজেপি-তৃণমূলের বোঝাপড়া কী ভাবে বাড়ছে! একে অপরকে সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে সক্রিয়!’’ বুধবার বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলি কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা মিছিলের ডাক দিয়েছে। বৃহস্পতিবার শিক্ষক সংগঠনগুলির আয়োজনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা হলে প্রতিবাদসভা হবে। সেখানে উপস্থিত থাকার কথা প্রভাত পট্টনায়ক, পবিত্র সরকার, ওমপ্রকাশ মিশ্রদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন