আইন বলছে, খাদ্য হিসেবে স্বীকৃত নয় কুকুরের মাংস। কিন্তু এত দিন পর্যন্ত নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরামে চলেছে অবাধ সারমেয় ভক্ষণ। বছর খানেক আগে তা নিষিদ্ধ হয়েছে মিজোরামে। এ বার নাগাল্যান্ডেও সরকারি ভাবে কুকুর মারা ও কুকুরের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হতে চলেছে।
বিষয়টি নিয়ে নাগাল্যান্ড, মিজোরামের পশুপ্রেমীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়েছেন। অসম ও মেঘালয় থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৫০-২০০টি করে কুকুর নাগাল্যান্ডে সরবরাহ করা হয়। কুকুরগুলির মুখ সেলাই করে, বস্তাবন্দি করে তাদের পাঠানো হয় ডিমাপুর-কোহিমায়। নাগাল্যান্ডে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কিলো দরে কুকুরের মাংস বিক্রি হয়। মণিপুর, মিজোরামে তার দাম কিলোপ্রতি ৫০০ টাকা। নাগাদের বিশ্বাস, কুকুরের মাংসে পুষ্টি বেশি। আছে রোগ সারানোর ক্ষমতাও। তাঁদের আরও ধারণা, সেই কারণেই চিন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড, আমেরিকা এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশে কুকুরের মাংসের এত কদর।
পিএফএ সদস্য তথা পশু অধিকার কর্মী সঙ্গীতা গোস্বামী অবশ্য জানালেন, গোটা বিশ্বেই কুকুরের মাংস খাওয়া বেআইনি। ভারতে ‘ফু়ড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অ্যাক্ট’, ‘প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যাল অ্যাক্ট’, ‘স্লটারহাউস অ্যাক্ট’ এবং ‘ট্রান্সপোর্ট অব অ্যানিম্যাল রুল’ অনুযায়ী কুকুর ধরা, সরবরাহ করা, মারা ও খাওয়া আইনসিদ্ধ নয়। কিন্তু নাগাল্যান্ড এবং মণিপুরের নাগা অধ্যুষিত এলাকায় তা রমরমিয়ে চলছে। পিএফএ-র আন্দোলনের পরে তিন বছর আগে মিজোরামে কুকুর ভক্ষণ নিষিদ্ধ করে ২৮টি দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে এখনও লুকিয়ে চুরিয়ে হয় কুকুর খাওয়া। অসমের গোলাঘাট জেলার সিলনিজান, নগাঁও জেলার কামপুর, মরিগাঁওয়ের জাগি রোড আর উলনি থেকে সব চেয়ে বেশি সংখ্যক কুকুর নাগাল্যান্ডে সরবরাহ করা হয়। শিলচরের লায়লাপুল থেকে এখনও মিজোরামে যায় কুকুর।
সম্প্রতি অসমের আইনজীবী এন এম কপাডিয়া কুকুরের মাংস বিক্রি ও খাওয়ার বিরুদ্ধে নাগাল্যান্ড সরকারকে আইনি নোটিস পাঠিয়েছিলেন। রাজ্যের পশুপালন বিভাগও সব জেলাশাসককে চিঠি পাঠিয়ে কুকুরের মাংসের ব্যবসা বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়। এর পরেই নড়ে বসে নাগাল্যান্ড সরকার। সে রাজ্যের মুখ্যসচিব পঙ্কজ কুমার বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের পশুপালন, স্বাস্থ্য, পুর ও পরিবার কল্যাণ দফতরের আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
মিজোরামের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেব বলেন, ‘‘বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা, আইনগত কিছু সমস্যার জন্য রাজ্য সরকার কুকুরহত্যা ও ভক্ষণ নিষিদ্ধ করতে আইন আনে। সেই পথেই হাঁটতে পারে নাগাল্যান্ড।’’ কুকুর ভক্ষণের সপক্ষে থাকা সরকারি কর্তারা অবশ্য সওয়াল করেন, সংবিধানের ৩৭১-এ অনুচ্ছেদ অনুসারে দেশের মূল ভূখণ্ডের বিভিন্ন আইনের ধারা থেকে নাগাল্যান্ড ছাড় পায়। তাঁদের যুক্তি, তাই কুকুরের মাংস সে রাজ্যে খাওয়া যেতেই পারে। মুখ্যসচিব জানান, এই সংক্রান্ত আইনগুলি খতিয়ে দেখার পরেই এ নিয়ে বিল আনার সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
এ খবর ছড়ানোর পর পরই অবশ্য রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। ডিমাপুর-কোহিমার বাজারে কুকুর মিলবে না— তা ভাবতেই পারছেন না স্থানীয় মানুষ। দোকানগুলিও মার খাবে। যদিও কিছু মানুষের বিশ্বাস, মাংস বেআইনি হলেও মিজোরামের মতোই বিক্রি থামবে না সেখানে। কিন্তু তাঁদের আশঙ্কা, কালোবাজারে দাম চড়বে চড়চড়িয়ে।
নাগাল্যান্ডের কিছু বাসিন্দার দাবি, জ্বর বা দুর্বলতায় এই মাংস আবশ্যিক পথ্য। কিন্তু সঙ্গীতাদেবী জানাচ্ছেন, এই মাংসে ওষধি গুণ নেই। অসমের পশুচিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক মীনেশ্বর হজারিকার মতে, কুকুরের মাংসে লোহা বেশি। তাই হয়তো রক্তাল্পতার ওষুধ হিসেবে তাকে ভাবা হয়। ডায়েটিশিয়ান ও চিকিৎসকদের মতে, এই মাংস শরীর গরম করে। তাই ঠান্ডা এলাকায় থাকা ও বিকল্প খাদ্যের জোগান সে ভাবে না থাকা মোঙ্গলদের মধ্যে কুকুরের মাংস জনপ্রিয় ছিল। নাগা-মিজোরা সেই জনগোষ্ঠীয় ধারার সদস্য। তাদের মধ্যে বংশানুক্রমেই ওই মাংসের জনপ্রিয়তা থেকে গিয়েছে।
নাগাল্যান্ডে কুকুর খাওয়ার বিরুদ্ধে আইন আসতে চলছে জানতে পেরে অসমের কুকুর সরবরাহকারীরাও চিন্তিত। সঙ্গীতাদেবী জানান, বিহুর আগে অসমের যুবকরা কুকুর নাগাল্যান্ডে পাঠিয়ে টাকা রোজগার করেন। তাই খুব শিগগির ওই সব এলাকায় তাঁদের নজরদারি শুরু হবে।