সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ নেতাদের একের পর এক মন্তব্যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রতিফলন। দিল্লিতে বিজেপির ভরাডুবির যেটি অন্যতম কারণ। তার উপরে বারাক ওবামার খোঁচা। সংসদের অধিবেশন শুরুর মুখে এ বারে মুখ খুললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আশ্বস্ত করলেন, তাঁর সরকার ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা পুরোপুরি সুনিশ্চিত করবে। বিরোধীরা অবশ্য এতে আশ্বস্ত হতে নারাজ। তাদের যুক্তি, মোদী আগেও এমন আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু সঙ্ঘ তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এবং সরকারের চাবি তাদেরই হাতে।
সংসদের গত অধিবেশন প্রায় ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ নেতা-সাংসদদের হিন্দুত্ববাদী মন্তব্য ও ধর্মান্তরণ বিতর্কে। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির পরেও এককাট্টা বিরোধীদের হাঙ্গামায় রাজ্যসভার অচলাবস্থা কাটেনি। আটকে গিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব বিল। হিন্দুত্ব বিতর্কে দেশের অর্থনীতি ধাক্কা খাচ্ছে, এই অভিযোগ করে আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবতকে সক্রিয় হওয়ার অনুরোধও করেছিলেন মোদী। নিজেও সাংসদদের ডেকে এ ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে বলেন। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। খাস দিল্লিতেই একের পর এক গির্জায় হামলা হয়েছে। এই সব বিতর্ক প্রচারে তুলে এনে অরবিন্দ কেজরীবাল দিল্লি নির্বাচনে বাজিমাত করেছেন। তার উপর ভারত সফরের একেবারে শেষ লগ্নে, এমনকী পরে দেশে ফিরে গিয়েও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা চড়া সুরে টেনে এনেছেন ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ঘটনার কথা।
এই অবস্থায় মোদীকে আসরে নামতে হল এক ঢিলে তিন পাখি মারতে। এক, দিল্লি বিপর্যয়ের পর যখন আরএসএস-ও মোদী ও অমিত শাহের সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখ খুলছে, তার পাল্টা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যেই সঙ্ঘ পরিবারকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, তারাও এই পরাজয়ের দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে না। একই সঙ্গে প্রকাশ্যে তিনি বার্তা দিলেন, ওই ধরনের ঘটনা তিনি আর বরদাস্ত করবেন না। দুই, সংসদের অধিবেশনে ফের যাতে হাঙ্গামা না হয়, তার জন্য আগেভাগেই প্রধানমন্ত্রী নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিলেন। আর তিন, ওবামা দু’-দু’বার ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এই পরিস্থিতিতে মোদীও তাঁর সরকারের অবস্থান জানিয়ে বার্তা দিতে চাইলেন আন্তর্জাতিক শিবিরকে। আর সে কারণেই তিনি আজ এই মন্তব্য করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন দিল্লিতে খ্রিস্টানদের আয়োজিত এক সম্মেলনকে। সম্প্রতি রাজধানীর একটি মিশনারি স্কুলে হামলার পরে দিল্লির পুলিশ কমিশনারকে ডেকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দিল্লিতে দলের ভরাডুবির এক দিন পর আপত্তি জানান মোদী-মূর্তি পুজো করা নিয়েও। আর আজ আর এক ধাপ এগিয়ে তিনি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বজায় রাখা নিয়ে কড়া বার্তা দিলেন।
মোদীর কথায়, “সংখ্যালঘু হোক বা সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠী একে অপরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বা তলে তলে ঘৃণা ছড়ালে আমার সরকার তা বরদাস্ত করবে না। যে কোনও ব্যক্তির কারও প্রভাব ছাড়াই নিজের পছন্দ মতো ধর্মে বিশ্বাস রাখা বা গ্রহণ করার অধিকার আছে। ঐক্য আমাদের শক্তিশালী করে, বিভাজন দুর্বল করে। একে অপরের ধর্মের প্রতি সহনশীলতার ঐতিহ্য বহু দিনের।”
প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে আদৌ মুগ্ধ নন বিরোধীরা। কংগ্রেস নেতা মণীশ তিওয়ারি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী মুখে যা-ই বলুন, বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। যে সঙ্ঘের হাতে বিজেপির চাবিকাঠি রয়েছে, তারা এখনও এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করেনি। প্রধানমন্ত্রী এর আগেও সংসদে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাতেও হিন্দুত্ববাদী আস্ফালন থামেনি। দিল্লি ভোটের ফল স্পষ্ট করে দিয়েছে, নরেন্দ্র মোদীর জাদু শেষ। সঙ্ঘের উপরেও প্রধানমন্ত্রীর কোনও কর্তৃত্ব নেই।”