সব ঠিক থাকলে বুধবারই রাজ্যসভায় জিএসটি বিল পাশ হতে পারে। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের শীর্ষ সূত্রের দাবি, পণ্য-পরিষেবা কর চালুর জন্য সংবিধান সংশোধনী বিলটি নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে যাবতীয় বিবাদ মিটে গিয়েছে। তাদের তিনটি দাবির মধ্যে দু’টিই মেনে নিচ্ছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। মেনে নেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা আপত্তিও।
শুধু বিলের বিষয়বস্তু নিয়ে নয়, কবে এটি রাজ্যসভায় আলোচনার জন্য তোলা হবে, সে ব্যাপারেও নিজেদের পরিকল্পনা থেকে পিছু হটেছে শাসক শিবির। সরকার আগামী কালই বিলটি আলোচনায় তুলতে চেয়েছিল। সেই মতো বিজেপির সব সদস্যকে মঙ্গলবার থেকে তিন দিন রাজ্যসভায় হাজির থাকার জন্য হুইপও জারি করা হয়। কিন্তু কংগ্রেস আপত্তি জানায় নিয়মের প্রশ্ন তুলে। তারা যুক্তি দেয়, সরকার বিলে যে সব পরিবর্তন আনছে, সেই সংশোধনীর তালিকা আগে সাংসদদের মধ্যে বিলি করতে হবে। তাই কালই বিলটি আলোচনায় তোলা চলবে না।
আসলে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী কাল বারাণসীতে ‘রোড শো’ করতে যাচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশের ভোটের দিকে চোখ রেখে মোদীর লোকসভা কেন্দ্রে গিয়েই অনুন্নয়নের অভিযোগ তুলবেন তিনি। বিজেপি নেতৃত্ব সনিয়ার কর্মসূচি থেকে প্রচারের আলো কেড়ে নিতেই ওই দিন জিএসটি বিল নিয়ে আলোচনা চাইছিলেন। কংগ্রেস তা হতে দিতে রাজি নয়। দিন নিয়ে দড়ি টানাটানির খেলায় বিজেপিকেই ঢিল দিতে হয় শেষ পর্ষন্ত। কারণ, কংগ্রেসের সাহায্য ছাড়া এই সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করানো সম্ভব নয়। ঠিক হয়, পরশুই বিলটি নিয়ে আলোচনা হবে। আগেই এর জন্য পাঁচ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ হয়ে রয়েছে। কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডুর আশা, সে দিনই বিলটি পাশ করানো যাবে।
তৃণমূল সংবিধান সংশোধনী এই বিলটিতে সমর্থন জানালেও, দেড় কোটি টাকার কম ব্যবসা করে এমন সংস্থার উপর কেন্দ্রের নজরদারি নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এতে ছোট ব্যবসায়ীদের হেনস্থা হতে হবে বলে তিনি মনে করেন। অন্য কয়েকটি রাজ্যও সহমত জানিয়েছিল এ বিষয়ে। জেটলির মন্ত্রক সূত্রের ইঙ্গিত, এই আপত্তি মেনে নিয়ে দেড় কোটি টাকার কম ব্যবসা করে এমন সংস্থার উপরে নজরদারির অধিকার থাকবে শুধু রাজ্যের হাতে। এই বিষয়টির সঙ্গে সংবিধান সংশোধনীর সম্পর্ক না থাকলেও এটা স্পষ্ট যে, জিএসটির পথ মসৃণ করতে আঞ্চলিক দলগুলিকেও পাশে নিয়েই এগোতে চাইছেন অরুণ জেটলিরা।
কংগ্রেসের দাবি ছিল তিনটি। এক, করের হার ১৮ শতাংশে বেঁধে রাখতে হবে সংবিধান সংশোধনী বিলেই। জেটলি জানিয়ে দেন, এই দাবি মানা সম্ভব নয়। মূলত তিনটি কারণে: l অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বদলের সঙ্গে করের হারও ওঠানামা করে। প্রত্যেক বার করের হার বদলাতে হলে সংবিধান সংশোধনের জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। l দামি ভোগ্যপণ্যের উপর ১৮ শতাংশের থেকে অনেক বেশি হারে কর বসাতে হবে। l রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরাও সংবিধান সংশোধনী বিলে করের হার বেঁধে দেওয়ার পক্ষে নন। তাঁদেরও মত ছিল, জিএসটি চালু হলে তার হার ঠিক করবে কেন্দ্র ও রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে তৈরি জিএসটি কাউন্সিল।
কংগ্রেসের অন্য দু’টি দাবি অবশ্য মেনে নিচ্ছেন মোদী-জেটলি। শিল্পোন্নত রাজ্যগুলিতে বাড়তি ১ শতাংশ হারে কর বসানোর প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে সরকার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্তও হয়ে গিয়েছে এ নিয়ে। তৃতীয় দাবি ছিল, জিএসটি নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য কোনও বিবাদ হলে তা মেটাতে পৃথক ব্যবস্থা তৈরি হোক। সেই দাবি মেনে নিয়ে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পৃথক আইন করে এর ব্যবস্থা করা হবে। এ জন্য শীতকালীন অধিবেশনে নতুন বিল আনা হবে।
এমন নয় যে বুধবার সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ হলে পর দিনই নতুন কর ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে। এমনকী, ১ এপ্রিল থেকেও এটা চালু হবে কি না, তা-ও নিশ্চিত নয়। কিন্তু জিএসটি নিয়ে মোদী সরকারের তাড়াটা কীসের? অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, এমনটা নয় যে অর্থ বছরের শুরু থেকেই জিএসটি চালু করতে হবে। যে কোনও মাসের প্রথম দিন থেকেই এটি চালু করা যাবে। কিন্তু আর্থিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জিএসটি চালু হতে হতে ২০১৯-এর লোকসভা ভোট কাছাকাছি চলে আসুক, এমনটা মোদী সরকার চাইবে না। কারণ জিএসটি চালু হলে প্রাথমিক ভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই মূল্যবৃদ্ধির বোঝা নিয়ে বিজেপি ভোটে যেতে চাইবে না।
জিএসটি চালুর জন্য ১২২-তম সংবিধান সংশোধনী বিল প্রথম পেশ হয়েছিল ২০১১ সালে, ইউপিএ জমানায়। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও মনমোহন সিংহের সরকার সেই বিলে ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারেনি। তার জন্য অবশ্য বিজেপিকেই দায়ী করে কংগ্রেস। মোদী সরকারও গত দু’বছর ধরে এই বিল নিয়ে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। সরকার ও বিরোধীদের উপর জিএসটি বিল পাশ করানোর জন্য চাপ আসছিল শিল্পমহল থেকেও। যুক্তি ছিল, জিএসটি চালু হলে গোটা দেশে অভিন্ন কর ব্যবস্থা চালু হবে। এক-এক রাজ্যে এক-এক রকম করের জটিলতা ও বাণিজ্যিক বাধা উঠে যাবে। ফলে অর্থনীতিতেও গতি আসবে। বাড়বে আর্থিক বৃদ্ধির হার। চলতি সপ্তাহে বিল পাশের প্রত্যাশায় সেনসেক্সও চড়তে শুরু করেছে।