রাহুলের ভাষণ শুনতে আশপাশের ঘর-বাড়ি, দোকানপাটের ছাদে, জানালায়, বারান্দায় সার সার মানুষ। শুক্রবার পাভি জেতপুরে।
চমকে উঠতে হল পাভি জেতপুর পৌঁছে। চমকের শুরুটা অবশ্য আরও কিছুটা আগেই। বোডেলির কাছাকাছি পৌঁছেই চারপাশটা কেমন অন্য রকম ঠেকতে শুরু করেছিল। গুজরাত-মধ্যপ্রদেশ সীমান্তের কাছাকাছি ছোট্ট শহরটায় পৌঁছে চমকটা সম্পূর্ণ হল।
রাহুল গাঁধীর জনসভা দুপুর ১২টায়। অমদাবাদ থেকে রওনা দিয়ে ছোটা উদয়পুর জেলার সেই জনসভায় পৌঁছতে কত সময় লাগতে পারে, তা নির্ভুল ভাবে আঁচ করা যায়নি গোড়ায়। বডোদরায় পৌঁছে ১ নম্বর ন্যাশনাল এক্সপ্রেসওয়ে ছেড়ে ১১ নম্বর রাজ্য মহাসড়ক ধরতে হবে, এটুকুই জানা ছিল। মোবাইলের জিপিএস যখন জানান দিল, রাজ্য মহাসড়ক ধরে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে ছোটা উদয়পুর জেলার পাভি জেতপুরে পৌঁছতে, তখন রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার জোগাড়। রাজ্য সড়কের হাল কেমন জানা নেই। সেই রাস্তা ধরে ৮৫ কিলোমিটার যেতে কত ক্ষণ লাগবে, কোনও ধারণা নেই। ঘড়ির কাঁটা ১১টা পেরিয়ে গিয়েছে।
পাভি জেতপুরে রাহুল গাঁধী।
প্রথম চমক গুজরাতের রাজ্য মহাসড়কটায় উঠে। জাতীয় সড়কের চেয়েও যে চকচকে হতে পারে রাজ্য সড়ক, তা বোধ হয় গুজরাতে না এলে বোঝা কঠিন। গাড়ির স্পিডোমিটারের দিকে চোখ গেল, কাঁটা ১১০ থেকে ১২০-র মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। রাজ্য সড়কে এই স্পিড! পশ্চিমবঙ্গে ভাবা যাবে এমনটা? তুলনাটা অজান্তেই হানা দেবে।
আরও পড়ুন: গুজরাত: প্রথম দফার মুখে হাতে ‘মণি’ পেল বিজেপি
প্রত্যন্ত অঞ্চল, আদিবাসী প্রধান জেলা। কিন্তু সুদূর প্রান্তেও সরকারি পরিকাঠামো পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা নজরে আসে। কেন তা হলে শাসকের বিপক্ষে যাবেন মানুষ? ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই গাড়ি পৌঁছে গিয়েছে বোডেলি। সেখান থেকেই রাস্তার দু’পাশে কমে এল বিজেপি-র পতাকা, ফেস্টুন, ব্যানার, ফ্লেক্স। সে সবের জায়গা নিয়ে নিল ‘পঞ্জা ছাপ’— হাত চিহ্ন।
গুজরাতে এ বার টানটান উত্তেজনার নির্বাচন, সে কথা ঠিক। অধিকাংশ এলাকাতেই যে কংগ্রেস জোরদার লড়াই দিচ্ছে, সে ছবি খুব স্পষ্ট। কিন্তু কংগ্রেস প্রচারে ও প্রভাবে যোজন এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি-র চেয়ে, এমনটা সচরাচর চোখে পড়ছে না। ছোটা উদয়পুর জেলা সেই দৃশ্যটাই দেখিয়ে দিল।
এই সভার অপেক্ষাতেই যেন ছিল গোটা জেলা।
পাভি জেতপুর নামেই শহর। আসলে আশপাশের অনেকগুলো প্রত্যন্ত গ্রামের জন্য একটা গঞ্জ গোছের, যেখানে খানিক হাটবাজার রয়েছে। বাংলার সঙ্গে তুলনা টানলে বলতে হয়, মহকুমা শহরের মতোও নয়। কোনও একটা ব্লক সদরের মতো। শুক্রবার সেখানেই রাহুল গাঁধীর জনসভা ছিল। কানায় কানায় ভরা এপিএমসি গ্রাউন্ড। অনেকেই ঢুকতে পারেননি মাঠের ভিতরে। বাইরে দাঁড়িয়েই শুনলেন মাইকে ভেসে আসা ভাষণ। আশপাশের ঘর-বাড়ি, দোকানপাটের ছাদে, জানালায়, বারান্দায় সার সার মানুষ। রাহুল স্বাভাবিক ভাবেই তীব্র আক্রমণ করলেন বিজেপিকে। গরিব আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিজেপি-র সরকার কিছুই করেনি বলে অভিযোগ করলেন। ‘বিকাশ’-এর নামে গুজরাতে শুধু ধনীর উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করলেন। জিএসটি ব্যবস্থা যে ভাবে প্রবর্তন করা হয়েছে এবং করের যে হার ধার্য হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ এবং গরিব মানুষ প্রবল সঙ্কটে পড়েছেন বলে মন্তব্য করলেন। সেই প্রসঙ্গেই টেনে আনলেন জয় শাহের কথা। বিজেপি-র আমলে এক জনেরই আর্থিক উন্নতি হয়েছে, তিনি হলেন অমিত শাহের পুত্র জয় শাহ— এ ভাবেই তীব্র কটাক্ষ ছুড়লেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি। জয় শাহের প্রসঙ্গ আসতেই মাঠ জুড়ে হাততালিও পড়ল জোরদার। মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য ঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতিও শুক্রবার দিয়ে গেলেন রাহুল গাঁধী। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে ১০ দিনের মধ্যে ঋণ মকুব করে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করলেন।
আরও পড়ুন: ভোটের গুজরাত যেন বদলের বাংলা
রাহুলের সভা শেষ হতেই বেজে উঠল বাজনা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিশাল ভিড় ধামসা-মাদল-কাঁসর সঙ্গে নিয়েই পাভি জেতপুরে হাজির হয়েছিল। রাহুল মঞ্চ ছাড়তেই বেজে উঠল সে সব। প্রবল উল্লাসে, উৎসবের মেজাজে, উৎসাহে-উদ্দীপনায় টগবগ করতে করতে নেচে-গেয়ে মাঠ ছাড়তে শুরু করল জনতা। ভোটযুদ্ধে জয় যেন হয়েই গিয়েছে, রাহুল গাঁধীর ভাষণই যেন শেষ কথা, শুধুমাত্র এই সভাটার অপেক্ষাতেই যেন ছিল গোটা জেলা।
নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের গুজরাতে এই দৃশ্য কিন্তু খুব সহজলভ্য নয়।
ছবি: পিটিআই।