এ এস দুলত
ললিত মোদী কাণ্ডের জেরেই মাঝেই ফের গুজরাত দাঙ্গার ভূত বের করে নরেন্দ্র মোদীকে সরাসরি আক্রমণের সুযোগ পেয়ে গেলেন বিরোধীরা।
সৌজন্যে গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রাক্তন প্রধান এ এস দুলতের একটি বই। সাম্প্রতিক কালে অনেক বই যেমন ভারতের রাজনীতির অভিমুখকে বদলে ফেলেছে, তাতে নতুন সংযোজন হল দুলতের ‘কাশ্মীর-দ্য বাজপেয়ী ইয়ার্স’ বইটি। যেখানে কন্দহর বিমান ছিনতাই থেকে হিজবুল মুজাহিদ্দিনের প্রধান সৈয়দ সালাউদ্দিনের ছেলেকে মেডিক্যাল কলেজে আসন দেওয়া পর্যন্ত নানা বিষয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারকে। কিন্তু বর্তমান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নরেন্দ্র মোদীকে সরাসরি আক্রমণের জন্য কংগ্রেস সবচেয়ে ব্যবহার করছে গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে দুলতকে করা বাজপেয়ীর মন্তব্যকে।
প্রাক্তন গুপ্তচর প্রধানের দাবি, বাজপেয়ীর সঙ্গে তাঁর শেষ বৈঠকের সময়ে ওই দাঙ্গার প্রসঙ্গ উঠেছিল। ব্যথিত মুখে বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘‘ওটা আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছে।’’ দুলতের দাবি, ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি-র হারের জন্যও গুজরাত অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করতেন বাজপেয়ী। এই দাবির প্রেক্ষিতে মোদীকে ফের গুজরাত দাঙ্গার খলনায়ক বানানোর চেষ্টায় আসরে নেমেছে কংগ্রেস। আজ কংগ্রেস নেতা অজয় কুমার বলেন, ‘‘গুজরাত দাঙ্গার সময়েই মোদীকে রাজধর্ম পালন করতে বলেছিলেন বাজপেয়ী। আজ এই ঘটনায় মোদীর জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেল। তা-ও সরকারের ভিতরের এক ব্যক্তির থেকে। এর পরে কি মোদী ক্ষমা চাইবেন?’’
বিজেপিও তড়িঘড়ি তার পাল্টা জবাব দিতে আসরে নামে। দলের মুখপাত্র এম জে আকবরকে দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করিয়ে জবাব দেওয়া হয়, ‘‘দশ বছর সনিয়া গাঁধীর সরকার চলার সময় গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দোষী সাব্যস্ত করতে কোনও কসুর করা হয়নি। তাতেও কংগ্রেসের হাত শূন্য থেকেছে। এ বারে ফের যখন এই ইস্যুতে তারা সরব হচ্ছে, তখন কী কংগ্রেস ক্ষমা চাইবে সেই ঘটনার জন্য?’’ কিন্তু কংগ্রেস তো না হয় বিরোধী দল হিসেবে রাজনীতি করবে, কিন্তু গুজরাতে ভুল হওয়ার কথা তো র’-এর প্রাক্তন প্রধান বলছেন। আকবরের জবাব, ‘‘আমাদের প্রতিক্রিয়া যেমন কংগ্রেসের প্রতি, তেমনই এটি দুলতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।’’ যার অর্থ, বিজেপি বলছে, কংগ্রেসের ইশারাতেই প্রাক্তন গুপ্তচর প্রধান আজ এমন কথা বলছেন।
দুলতকে নিয়ে বিজেপির অস্বস্তি অবশ্য কেবল গুজরাত দাঙ্গায় থেমে নেই। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের আইসি-৮১৪ বিমানের যাত্রীদের বিনিময়ে মৌলানা মাসুদ আজহার, শেখ ওমর সইদ ও মুস্তাক জারগারের মতো তিন জঙ্গির মুক্তি এখনও তাড়া করে বিজেপিকে। সেই ক্ষতে আরও নুনের ছিটে দিয়ে দুলত জানিয়েছেন, ভারত সরকারের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ কোনও সিদ্ধান্ত নিতে না পারার ফলেই ছিনতাই বিমানটিকে ভারতের মাটিতে আটকানো যায়নি। নেপাল থেকে ওড়ার পরে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে আইসি-৮১৪। কিন্তু পরে অমৃতসরে জ্বালানি নিতে নেমেছিল বিমানটি। সেখানেই তাকে অচল করে দেওয়া যেত। দুলতের দাবি, পঞ্জাব পুলিশের কম্যান্ডোরা এই কাজ করতে পারতেন। কিন্তু নিজেদের সিদ্ধান্তহীনতার জন্য তাঁদের নির্দেশ দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ও পঞ্জাব সরকার। বিমানটি আফগানিস্তানের কন্দহরে চলে যাওয়ার পরে বিষয়টি নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপ শুরু হয়। বিমানটি দুবাইয়ে নামার পরে সেখানেও ভারত কম্যান্ডো হানা চালানোর কথা ভেবেছিল বলে দাবি করেছেন প্রাক্তন গুপ্তচর প্রধান। কিন্তু আমেরিকা বা সংযুক্ত আরব আমিরশাহি-কেউই ভারতের প্রস্তাব মানেনি বলে জানিয়েছেন তিনি।
এই প্রসঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লার কথা উল্লেখ করেছেন দুলত। তিন জঙ্গির দু’জন ছিল কাশ্মীরের জেলে। ফারুককে বুঝিয়ে তাদের দিল্লিতে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দুলতকে। ফারুক প্রবল ভাবে তিন জঙ্গিকে মুক্তি দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন বলে জানিয়েছেন দুলত। প্রাক্তন গুপ্তচর প্রধানের দাবি, তাঁর সঙ্গে তর্কাতর্কির পরে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে রাজভবনে চলে যান ফারুক। কিন্তু রাজ্যপাল তাঁকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করেন। এই বিষয়টি নিয়েও বিজেপিকে আজ কটাক্ষ করেছে কংগ্রেস। অটল জমানাতেই জঙ্গি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের নেতা সৈয়দ সালাউদ্দিনের ছেলেকে কাশ্মীরে মেডিক্যাল কলেজের আসন পাইয়ে দিতে গোয়েন্দা ব্যুরো সাহায্য করেছিল বলে দাবি প্রাক্তন গুপ্তচর প্রধানের। তাঁর মতে, ওই সাহায্যের প্রতিদানে অনেক জঙ্গি আত্মসমর্পণ করবে বলে ভাবা হয়েছিল।
তবে প্রাক্তন গুপ্তচর প্রধানের দাবি কেবল বাজপেয়ী জমানায় সীমাবদ্ধ নয়। কেন্দ্রে ভি পি সিংহ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদের মেয়ে, অপহৃত রুবাইয়ার বিনিময়ে পাঁচ জঙ্গির মুক্তি নিয়েও মুখ খুলেছেন তিনি। দুলতের দাবি, সে বারও হিসেবে ফারুককে বোঝানোর প্রাথমিক দায়িত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল। সে বারও বিরোধিতা করেছিলেন ফারুক।
প্রাক্তন গুপ্তচর প্রধানের দাবিকে পুঁজি করে কংগ্রেস মাঠে নামতেই জবাব দিতে তৈরি হয়ে যায় বিজেপি। আকবর দাবি করেন, কন্দহর সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়েই করা হয়েছিল। তাঁর কথায়, ‘‘কংগ্রেস কি এখন বলতে চায় যে ছিনতাই হওয়া বিমানের যাত্রীদের মরতে দেওয়া উচিত ছিল?’’ আকবরের আরও বক্তব্য, ‘‘সৈয়দ সালাউদ্দিনের ছেলেকে মেডিক্যালে আসন পাওয়ানোর সঙ্গে অটল সরকারের কোনও যোগ নেই। কংগ্রেস বরং তাদের বন্ধু ফারুক আবদুল্লার কাছে জানতে চাক, কী হয়েছিল।’’