ভারত প্রেমকথা

সমকাম অপরাধ নয়, ঐতিহাসিক রায় শীর্ষ আদালতের

‘‘বছরের পর বছর সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য এলজিবিটি সম্প্রদায়ের কাছে ইতিহাসের ক্ষমাপ্রার্থনার দায় থেকে যায়।’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:২৫
Share:

জয়: সমকামিতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে উল্লাস। বৃহস্পতিবার বেঙ্গালুরুতে। এএফপি

ভালবাসার আবেদনে সাড়া দিল সুপ্রিম কোর্ট। ‘১৫৬ বছরের নিপীড়ন’ থেকে রামধনু পতাকাকে মুক্ত করে জানিয়ে দিল, সমকামিতা অপরাধ নয়।
ব্রিটিশ আমলে তৈরি ১৮৬১ সালের ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় সমকামী যৌন সম্পর্ককে অপরাধের তকমা দেওয়া হয়েছিল। একে ‘অসাংবিধানিক’ বলে খারিজ করে দিয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ আজ রায় দিয়েছে, ৩৭৭ ধারা সমকামীদের সমানাধিকারে ধাক্কা দিচ্ছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘আমি যা, আমি তা-ই। আমাকে সে ভাবেই গ্রহণ করতে হবে।’’ পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের সদস্যরা চারটি পৃথক রায়ে একই সুরে লিখেছেন, যৌন পছন্দ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। তাই তার ভিত্তিতে ভেদাভেদ করা সংবিধানের ১৪তম অনুচ্ছেদের (নাগরিকদের সমানাধিকার ও আইনি নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে) বিরোধী। বেঞ্চের অন্যতম বিচারপতি ইন্দু মলহোত্র বলেন, ‘‘বছরের পর বছর সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য এলজিবিটি সম্প্রদায়ের কাছে ইতিহাসের ক্ষমাপ্রার্থনার দায় থেকে যায়।’’
৩৭৭ ধারায় বলা হয়েছিল, সমলিঙ্গের যৌন সম্পর্ক বা পায়ুকাম প্রকৃতি-বিরুদ্ধ, তাই আইনত অপরাধ। যা প্রয়োগ করে, যৌন সম্পর্কের ‘অপরাধে’ সমকামীদের জেলে পুরতে পারত পুলিশ। প্রশ্ন ছিল, পুলিশ তথা রাষ্ট্র কেন মানুষের ব্যক্তি পরিসরে নাক গলাবে? আজ প্রধান বিচারপতি সুপ্রিিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ বলেছে, সমকামী, রূপান্তরকামী, উভকামী তথা এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষেরও নিজের পছন্দ মতো সঙ্গী বেছে নিয়ে, ভালবাসা, যৌন তৃপ্তি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। যেমন রয়েছে আর পাঁচ জন সাধারণ নাগরিকের। নিজস্ব ইচ্ছে প্রকাশের বাধা মৃত্যুর সমান। তাই পুরনো ধ্যানধারণাকে বিদায় জানাতে হবে। ভিক্টোরীয় নীতিবোধের ভিত্তিতে তৈরি আইন দিয়ে সমকামীদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না।

Advertisement

বিচারের বাণী
আমি যা আমি তা-ই। আমাকে আমার মতো করেই গ্রহণ করুন।


সামাজিক নীতিনৈতিকতার নামে একটি মানুষের অধিকারও খর্ব করা চলে না।

Advertisement


ব্যক্তির যৌনরুচি প্রাকৃতিক বিষয়। তার নিরিখে বৈষম্য
করা ব্যক্তির মতপ্রকাশের অধিকারকে লঙ্ঘন।


এলজিবিটি সম্প্রদায়ের কাছে ইতিহাসকে ক্ষমা চাইতে হবে। যে বৈষম্য তাদের সঙ্গে হয়েছে, সমাজ তাদের যে ভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, ক্ষমা তার জন্যই।


রায় ঘোষণা করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘৩৭৭ ধারা অযৌক্তিক, নিয়মবহির্ভূত এবং বোধাতীত। কারণ এলজিবিটি সম্প্রদায়ের সমানাধিকারে তা হস্তক্ষেপ করে। সমাজের নৈতিক ধ্যান-ধারণা এক জন নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন করতে পারে না।’’ তাঁর যুক্তি, সংখ্যাগুরুর মত বা সমাজের জনপ্রিয় মত সাংবিধানিক অধিকার বাতলে দিতে পারে না। সংবিধান মেনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কার পক্ষে মত বেশি, তা দেখে নয়। প্রধান বিচারপতি তাঁর ও বিচারপতি এ এম খানউইলকরের রায় পড়ে শোনানোর পরে বিচারপতি ধনঞ্জয় চন্দ্রচূড়, বিচারপতি রোহিংটন নরিম্যান এবং বিচারপতি ইন্দু মলহোত্র নিজেদের রায় পড়ে শোনান।

আরও পড়ুন: লড়াকু সেই পাঁচ জন

এক এক করে বিচারপতিরা রায় শুনিয়েছেন। এজলাসের দর্শকাসনে বসে হাত মুঠো করে নীরবে জয়োল্লাস করেছেন নাজ় ফাউন্ডেশনের কর্ণধার অঞ্জলি গোপালন। ২০০৯-এ এই নাজ় ফাউন্ডেশনের আর্জিতেই দিল্লি হাইকোর্ট ৩৭৭ ধারাকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে সমকামিতাকে অপরাধ-মুক্ত করেছিল। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন দিল্লির জ্যোতিষী সুরেশ কৌশল। ২০১৩-য় সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ দিল্লি হাইকোর্টের রায়কে খারিজ করে দিয়ে ৩৭৭ ধারা ফিরিয়ে আনে।
তখন নাজ় ফাউন্ডেশন এবং একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি নিজেদের সমকামী ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। তাঁদের আর্জিতেই আজ সুপ্রিম কোর্ট সেই পুরনো রায়কেও খারিজ করেছে। অঞ্জলির প্রতিক্রিয়া, ‘‘সমকামিতাকে শুধু অপরাধ নয়, রোগ হিসেবে দেখা হত। সমকামিতা সারাতে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হত। তার বিরুদ্ধে আমরা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে যাওয়ায়, কমিশন বলেছিল, এটি আইনত অপরাধ বলে কিছু করার নেই।’’

আরও পড়ুন: সিরাস যদি থাকত, আক্ষেপ আলিগড়ের বন্ধুর

আইনজীবীরা বলছেন, গত বছর সুপ্রিম কোর্ট ব্যক্তি পরিসরের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার পরেই বোঝা গিয়েছিল, ৩৭৭ ধারার উপরে এ বার কোপ পড়বে। কারণ ৩৭৭ ধারায় পুলিশকেই ব্যক্তি পরিসরে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা দেওয়া ছিল। এর পরে মানসিক স্বাস্থ্য আইনেও কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত সমকামিতাকে আইনত স্বীকৃতি দিয়েছে। বলা হয়েছে, সমকামিতা মানসিক অসুস্থতা নয়। আজ বিচারপতিরা এই দুইয়ে ভর করেই ৩৭৭ ধারার উপরে লাল কলম চালিয়েছেন। তবে ৩৭৭ ধারায় শিশু ও পশুদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ককে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট।
অনেকে বলেছেন, ভারতীয় দণ্ডবিধিতে পুরুষের ধর্ষণ সম্বন্ধে কোনও স্পষ্ট বিধি নেই। তাই ৩৭৭ ধারা ব্যবহার করে অভিযোগ জানাতে পারতেন কোনও ধর্ষিত পুরুষ। তবে এই আশঙ্কা অমূলক বলে জানিয়েছেন ৩৭৭-বিরোধী আন্দোলনকারীরা। তাঁদের মতে, পায়ুকাম ও পায়ু ধর্ষণ, এই দু’টো সম্পূর্ণ পৃথক। ঠিক যেমন ধর্ষণ ও যৌনমিলন আলাদা। আজকের রায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে পারস্পরিক সহমতের ভিত্তিতে যে সমকামী সম্পর্ক তৈরি হয়, তাকেই আইনি মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। কোনও ধরনের ধর্ষণকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। তা ছাড়া, নির্ভয়া কাণ্ডের পরে ধর্ষণ আইন সংশোধন করা হয়েছিল। তখন মহিলা ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ‘পায়ু ধর্ষণ’কে ধর্ষণের আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
আইনজীবীদের ব্যাখ্যা, সুপ্রিম কোর্ট ৩৭৭ ধারায় সমকামিতাকে অপরাধ-মুক্ত করে দেওয়ার পরে পুলিশের সমকামীদের হেনস্থা করার কোনও ক্ষমতা রইল না। কারণ তা সংবিধান বিরোধী কাজ হবে। সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলেছে, ৩৭৭ ধারায় যে সব মামলা ঝুলছে, সেখানেও এই রায়কে বিবেচনা করতে হবে। আজ বিচারপতি রোহিংটন নরিম্যান তাঁর রায়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন, সমস্ত রকম মাধ্যমে আজকের রায়ের বিপুল প্রচার করতে হবে। বিশেষত পুলিশকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এর পর যে সমকামীদের বিয়ে ও অন্যান্য অধিকারও প্রাপ্য, তার ইঙ্গিত দিয়ে বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, ‘‘সমকামিতাকে অপরাধ-মুক্ত করা প্রথম ধাপ। সংবিধান আরও অনেক অধিকার দিয়েছে।’’
সমলিঙ্গের বিয়ে ও সমকামী দম্পতির দত্তক নেওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে কবে আইন আনবে সরকার, সে দিকেই তাকিয়ে দেশের এলজিবিটি সম্প্রদায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন