Indian Army’s Tactical Move

নিয়ন্ত্রণরেখা ও সীমান্তে আবার সামরিক বিন্যাস! ভারত বাহিনী বাড়াচ্ছে, প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থায় জুড়ছে অস্ত্রের সম্ভারও

সীমান্তে নজরদারির জন্য নিরন্তরই যে উন্নততর প্রযুক্তির খোঁজে থাকতে হয়, সে কথা বর্তমান সেনাকর্তারাও বলছেন। তবে পহেলগাঁও হামলা এবং অপারেশন সিঁদুর পরবর্তী পরিস্থিতিতে এই প্রযুক্তিকে আর শুধু ‘রক্ষণাত্মক’ সীমায় বেঁধে রাখা হচ্ছে না। এ বার নজরদারি ব্যবস্থায় ‘আক্রমণাত্মক’ সরঞ্জামও যুক্ত হচ্ছে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২৫ ১৩:৩৭
Share:

—প্রতীকী ছবি।

ঠিক চার মাস কেটেছে পহেলগাওঁয়ের ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হানার পরে। অপারেশন সিঁদুরের পরে কেটেছে সাড়ে তিন মাস। এর মধ্যেই নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে নিয়ন্ত্রণরেখা এবং আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর। কোনও ‘উদ্বেগজনক’ পরিস্থিতির কথা আলাদা করে সেনা বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়নি। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর একাধিক এলাকায় যে ‘সামরিক পুনর্নিয়োজন’ করা হয়েছে, সে কথা সেনা আধিকারিকেরাই জানিয়েছেন। সীমান্ত এবং নিয়ন্ত্রণরেখায় নজরদারিও দুর্ভেদ্য করার চেষ্টা হচ্ছে সেন্সর, ড্রোন, এয়ার ডিফেন্স গান সম্বলিত ‘অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ব্যবস্থা’ চালু করে। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ হল সীমান্তবর্তী এলাকায় বাহিনী পাঠানো সংক্রান্ত পদক্ষেপ। যে ভাবে বাহিনী মোতায়েন হচ্ছে, তাকে ‘সামরিক প্রস্তুতি’র সঙ্গে তুলনাও করছেন কেউ কেউ।

Advertisement

নিয়ন্ত্রণরেখা এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তে যে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তার পোশাকি নাম ‘অ্যান্টি ইনফিলট্রেশন অবস্ট্যাক্‌ল সিস্টেম’ (এআইওএস)। পহেলগাঁও হামলার আগে এমন প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারির কথা ভাবা হয়নি, এমন নয়। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকেই প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি শুরু হয়েছিল। কিন্তু প্রযুক্তি যেমন ধাপে ধাপে উন্নততর হয়েছে, তাকে ফাঁকি দেওয়ার কৌশলও সন্ত্রাসবাদীরা তেমন ধাপে ধাপেই খুঁজে নিয়েছে। তাই এ বার আর শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি নয়, তার সঙ্গে জুড়ছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসম্ভারও।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিক কর্নেল সৌমিত্র রায়ের কথায়, ‘‘আশির দশকের শেষ দিক থেকে জম্মু-কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ এবং জঙ্গি গতিবিধি মারাত্মক বেড়ে যায়। তখন শুধু নিয়ন্ত্রণরেখার আশপাশের এলাকা নয়, একেবারে রাজধানী শ্রীনগর পর্যন্ত পাক সন্ত্রাসবাদীদের অবাধ গতিবিধি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই গতিবিধি তুঙ্গে পৌঁছোনোয় দেশের নানা প্রান্ত থেকে বাহিনী পাঠানো শুরু হয়। আমাদের ডিভিশনকেও তখন জম্মু-কাশ্মীরে পাঠানো হয়েছিল। আমরা যখন পৌঁছেছি, তখন শ্রীনগরের ঘরে ঘরে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। আমাদের প্রথম কাজ ছিল উপত্যকাকে পাকিস্তানি পতাকা-মুক্ত করা। তার পরে সীমান্তে নজর দেওয়া।’’

Advertisement

তখনই প্রথম প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল বলে কর্নেল রায় জানাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘তখন কাঁটাতারের দু’দফা বেড়ার মাঝে কাঁটাতারের কয়েল বিছিয়ে সীমান্ত এবং নিয়ন্ত্রণরেখা ঘিরে রাখা হত। আর পায়ে হেঁটে নজরদারি (ফুট পেট্রল) চলত। কিন্তু বোঝা গেল, ওই দুর্গম এলাকায় পায়ে হেঁটে নজরদারি যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তি অপরিহার্য। তাই ইজ়রায়েল থেকে অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আনা হয়েছিল। যদিও সে সময়ে তা প্রকাশ্যে জানানো হয়নি।’’

প্যালেস্তাইনের সীমান্তে নজরদারি দুর্ভেদ্য রাখতে ইজ়রায়েল তার অনেক আগেই প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ইজ়রায়েলের সেই দক্ষতাকে জম্মু-কাশ্মীরে কাজে লাগানো হয়েছিল বলে অবসরপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিকের বক্তব্য।

তার পরে ধাপে ধাপে সীমান্ত পাহারায় প্রযুক্তির গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রতি বারই প্রযুক্তিকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য কোনও না কোনও পন্থা সন্ত্রাসবাদীরা খুঁজে নিয়েছে বলে কর্নেলের দাবি। ১৯৬৫ সালে ভারতীয় সেনার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তানের ২০-২২ কিলোমিটার ভিতরে শিয়ালকোটের আলহার রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত এলাকা দখলে নিয়েছিলেন কর্নেল রায়রা। ফলে পাকিস্তানিদের গতিবিধি এবং সক্ষমতা-দুর্বলতা আশি বা নব্বইয়ের দশকের অনেক আগে থেকেই তাঁদের জানা ছিল। তা সত্ত্বেও নব্বইয়ের দশকে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া সীমান্ত বা নিয়ন্ত্ররেখাকে দুর্ভেদ্য রাখা যাচ্ছিল না। এমনকি, সীমান্তের বেড়াকে বিদ্যুদয়িত করেও অনুপ্রবেশ রোখা যাচ্ছিল না। কর্নেল রায়ের কথায়, ‘‘আমরা সীমান্তের বেড়ায় বিদ্যুৎপ্রবাহ শুরু করে দিলাম। প্রথম কিছু দিন তাতে সন্ত্রাসবাদীরা আটকে গেল। কিন্তু তার পরে লম্বা কাঠের তক্তা এনে সেই বেড়ার উপরে ফেলতে লাগল। কাঠ বিদ্যুতের অপরিবাহী। তাই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ভয় নেই। ওই তক্তা বেয়ে উঠে তারা বেড়া টপকাতে শুরু করল। সুতরাং উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়ল।’’

সীমান্তে নজরদারির জন্য নিরন্তরই যে উন্নততর প্রযুক্তির খোঁজে থাকতে হয়, সে কথা বর্তমান সেনাকর্তারাও বলছেন। তবে পহেলগাঁও হামলা এবং অপারেশন সিঁদুর পরবর্তী পরিস্থিতিতে এই প্রযুক্তিকে আর শুধু ‘রক্ষণাত্মক’ সীমায় বেঁধে রাখা হচ্ছে না। এ বার নজরদারি ব্যবস্থায় ‘আক্রমণাত্মক’ সরঞ্জামও যুক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ এমন একটি সুসংহত ব্যবস্থা, যাতে উন্নত মানের ক্যামেরা, রেডার, লেজ়ার রশ্মির বেড়া তো থাকছেই। তার সঙ্গেই পুরোদস্তুর ‘কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ ব্যবস্থার মাধ্যমে জুড়ে থাকছে নজরদারি ড্রোন, এয়ার ডিফেন্স গান এবং কামিকাজ়ে ড্রোন। এক একটি সীমান্ত চৌকিতে বসে দু’পাশে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় নজর রাখা যাবে ক্যামেরার মাধ্যমে। সীমান্ত বা নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘনের চেষ্টা হলেই লেজ়ার রশ্মির বেড়া সঙ্কেত পাঠিয়ে দেবে। অ্যালার্ম বাজতে শুরু করবে বিভিন্ন সীমান্ত চৌকিতে এবং কন্ট্রোল সেন্টারে। ফলে লেজ়ার বেড়ার সেন্সর থেকে আসা সঙ্কেতের উৎসস্থল সীমান্ত চৌকিতে বসেই চিহ্নিত করা যাবে। দ্রুত ড্রোন পাঠিয়ে আক্রমণ করা যাবে। আর উল্টো দিক থেকে ড্রোনের মাধ্যমে সীমান্ত লঙ্ঘন বা অস্ত্র পাচারের চেষ্টা হলে রেডারে সে গতিবিধি চিহ্নিত হয়ে যাবে। লক্ষ্যবস্তুর দিকে আক্রমণ শুরু হবে এয়ার ডিফেন্স গান এবং কামিকাজ়ে ড্রোনের মাধ্যমে। অপারেশন সিঁদুর চলাকালীন পাকিস্তান যে ভাবে বিভিন্ন ধরনের ড্রোন পাঠিয়ে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছিল, সে কথা মাথায় রেখেই এই নতুন ব্যবস্থা বলে সেনা সূত্রের খবর।

তবে শুধু এই প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি নয়, বাহিনীর ‘সামরিক পুনর্নিয়োজন’ও (বাহিনীর পরিভাষায় ‘ট্যাকটিকাল রিডেপ্লয়মেন্ট) তাৎপর্যপূর্ণ চেহারা নিয়েছে। গত কয়েক মাসে কোন কোন এলাকায় বিপদ সবচেয়ে বেড়েছে, তা খতিয়ে দেখে পুরোদস্তুর যুদ্ধের প্রস্তুতি রেখেই বাহিনী ও সরঞ্জাম মোতায়েন হয়েছে। শুধু সীমান্তে নয়, অপেক্ষাকৃত অভ্যন্তরীণ কিছু এলাকাকেও বিপদের আশঙ্কার ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানেও বাহিনী ‘পুনর্নিয়োজন’ হয়েছে। তবে এই সামরিক বিন্যাস আরও বাড়াতে চাইছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। তাই কিছু এলাকায় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ভার সিআরপিএফ-কে দেওয়ার তোড়জোড়ও শুরু হয়েছে। ওই সব এলাকায় মোতায়েন সেনা এবং রাষ্ট্রীয় রাইফেল্‌সের জওয়ানদের বিপদসঙ্কুল এলাকার দিকে পাঠানোর পরিকল্পনাও তৈরি করা হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement