ফাইল চিত্র।
ফ্রান্সের নিস কিংবা বাংলাদেশের গুলশন— সাম্প্রতিক হওয়া জঙ্গি হামলাগুলির পিছনে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে বলেই মনে করছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। প্রাথমিক তদন্তে ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে যে দুটি ঘটনার পিছনেই আইএসের হাত রয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বলছে, দুটি দেশেই আইএসের শক্ত ঘাঁটি না থাকলেও, আইএস মনোভাবাপন্নরা যে এসব দেশে রয়েছে তা জানান দিতে ওই হামলা চালানো হয়েছে।
শুরুর দিকে আইএসের কর্মকাণ্ড মূলত সীমিত ছিল ইরাক ও সিরিয়াতে। গত কয়েক বছরে ওই দুই দেশের বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ দখল করতে সক্ষম হয় আইএস জঙ্গিরা। কিন্ত আমেরিকা ও রাশিয়ার যৌথ হামলায় গত ছ’মাসে ক্রমশ জমি হারাতে শুরু করে তারা। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, যে তেল বেচে এত দিন ফুলে ফেঁপে উঠেছিল আইএস, হাতছাড়া হয় সেই তেলের খনিগুলিও। ফলে কমেছে আয়ও। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বা ফ্রান্সের নাশকতা দেখে গোয়েন্দাদের বিশ্লেষণ, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নাশকতার কৌশল পাল্টাতে শুরু করেছে এই জঙ্গিরা।
কী সেই কৌশল?
গোয়েন্দাদের কথায়, বহুজাতিক সংস্থা যেমন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ফ্র্যাঞ্চাইজি খোলে, তেমনি এ ক্ষেত্রে আইএস বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে। বিভিন্ন দেশে যে জঙ্গি সংগঠনগুলি আইএস ভাবধারায় বিশ্বাসী তাদের এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তারা। রাজনাথের কথায়, “ছোট সংগঠনগুলিকে প্রভাবিত করে তাদের মাধ্যমে নাশকতা চালানো শুরু হয়েছে। কী ভাবে, কোথায় আক্রমণ করতে হবে তা জানানোর পাশাপাশি হামলা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্রের জোগান দিচ্ছে আইএস।” কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের ব্যাখ্যা, স্থানীয়দের ব্যবহার করার পিছনে অন্যতম কারণ হল হামলাস্থলের টোপোগ্রাফি সম্বন্ধে স্থানীয় যুবকরা অনেক বেশি ওযাকিবহাল। কী ভাবে, কখন হামলা চালালে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে সে বিষয়ে স্থানীয়রা ভাল জানে বলেই তাদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিচ্ছে আইএস। তারপর হামলার পরে সেই নাশকতার দায় নিচ্ছে তারা। যেমনটি নেওয়া হয়েছে গুলশন বা নিসে।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা স্বীকার করে নিচ্ছেন, অন্যান্য দেশের মতোই ভারতে ক্রমশ ডালপালা মেলছে আইএস। গত কয়েক বছরে এ দেশে যে ভাবে আইএসের ভাবধারা ছড়িয়ে পড়ছে তাতে উদ্বিগ্ন রাজনাথ সিংহ। সম্প্রতি হায়দরাবাদে আইএসের মডিউল ধরা পড়েছে। ওই ঘটনায় গ্রেফতার হয় দু’জন। যাদের কাজ ছিল এ দেশে নাশকতা চালানো। রাজনাথ জানান, “সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে আইএস জঙ্গি গ্রেফতারের ঘটনাও যথেষ্ট চিন্তার। তাই পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্তে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।”
এক দিকে এই জঙ্গিদের দেশের মাটিতে হামলা চালানোর পরিকল্পনা, অন্য দিকে আইএস ভাবধারায় বিশ্বাসী হয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠায় যুবকদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাও একই সঙ্গে চিন্তায় রেখেছে কেন্দ্রকে। শুরুর দিকে মহারাষ্ট্র থেকে প্রায় ডজন খানেক যুবকের পরে এবার কেরল থেকে গত সপ্তাহে ১৭ জন যুবক ভারত ছেড়েছেন আইএসের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে। তারা সিরিয়া পৌঁছে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করেছেন বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। এই যুবকেরা অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত, কম্পিউটার জানা টেক-স্যাভি। শিক্ষিত এই যুবকদের এখন মগজধোলাই করে দলে টানছে আইএস। রাজনাথের কথায়, “গোটা পৃথিবীতে অতি বামপন্থী বিপ্লবের দিন শেষ। সেই জায়গা নিয়েছে এখন এই ধরনের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি। যারা নিজেদের কট্টর ভাবধারার মাধ্যমে যুবকদের অনুপ্রাণিত করছে। স্বপ্ন দেখাচ্ছে গোটা বিশ্ব জুড়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠার। আর সেই লক্ষ্যপূরণে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে দ্বিধা করছে না এই যুবকেরা।”
এর মধ্যে দেখা গিয়েছে মহারাষ্ট্র-সহ দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে আইএসের প্রভাব সবথেকে বেশি। আর তাই পরিস্থিতি সামলাতে পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের ১২ টি রাজ্যকে বিশেষ ভাবে সতর্ক করে দিয়েছে কেন্দ্র। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, ভারতে আইএসের সন্ত্রাসের বিপদ আসতে চলেছে নতুন চেহারায়। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, আইএস জঙ্গিরা ভারতে সন্ত্রাসবাদী হামলার জন্য ভারতীয় যুবকদের দায়িত্ব দিয়েছে। গোয়েন্দাদের মতে, ভারত থেকে যে সব যুবক সিরিয়া-ইরাকে ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছে তাদের উপর এ দেশে হামলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দারাও ইতিমধ্যেই নয়াদিল্লিকে জানিয়েছে, আইএসও ভারতে আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজ্যগুলির নিয়মিত ভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছে কেন্দ্র। বিষয়টি নিয়ে আন্তঃরাজ্য পরিষদের বৈঠকে রাজনাথ বলেন, “আইএসের সন্ত্রাস প্রতিবেশী দেশের মাটিতে পৌঁছে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র-রাজ্য উভয়ে একযোগে কাজ করতে হবে।” উভয় শিবিরের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের উপর জোর দিয়েছেন রাজনাথ সিংহ।
আরও খবর...