(বাঁ দিক থেকে) নরেন্দ্র মোদী, শেখ হাসিনা এবং মুহাম্মদ ইউনূস। —ফাইল চিত্র।
মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনাকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। হিংসায় উস্কানি দেওয়া, হত্যার নির্দেশ এবং দমনপীড়ন আটকানোর ক্ষেত্রে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা—এই তিন অভিযোগে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে ট্রাইবুনাল। বর্তমানে ভারতে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেত্রী হাসিনা। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, হাসিনাকে ফেরাতে চেয়ে ভারতের কাছে আবারও চিঠি দেবেন তাঁরা। তবে বিচারের সম্মুখীন হতে ভারত তাঁকে আদৌ বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী আদালতের রায়ে প্রত্যর্পণ করানোর মতো অপরাধ করে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এক দেশ অপর দেশের হাতে তুলে দেবে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেই হাসিনাকে ফেরত চেয়ে নয়াদিল্লিকে ‘কূটনৈতিক চিঠি’ (ভার্বাল নোট) পাঠিয়েছিল মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। ওই চিঠির প্রাপ্তিস্বীকারও করেছিল ভারত। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছিলেন, হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়ে বাংলাদেশের একটি চিঠি তাঁরা পেয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য এখনই করা যাবে না বলে জানান তিনি। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছিল, আগে ওই চিঠির বৈধতা যাচাই করতে চায় নয়াদিল্লি। কোনও দেশের অন্তর্বর্তী সরকার (যা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়) অন্য রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকারের কাছে কোনও রাজনৈতিক নেতার প্রত্যর্পণ চাইলে, আইনি দিকগুলি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
চলতি বছর অক্টোবর মাসে হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়ে ফের নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেয় ভারত। ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী জানান, এটির সঙ্গে আইনি বিষয় জড়িয়ে আছে। উভয় দেশের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তিনি আরও বলেন যে, “আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে, এটি একটি বিচার বিভাগীয় এবং আইনি প্রক্রিয়া। এর জন্য দু’দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা এবং পরামর্শের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি এবং এই বিষয়গুলি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও একসঙ্গে কাজ করার জন্য তৈরি।
ভারত কি হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য?
বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির মধ্যে থাকা বেশ কয়েকটি শর্তের জন্যই ভারত হাসিনাকে ফেরাতে বাধ্য নয় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এই প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার বলেন, “ভারত হাসিনাকে ফেরাতে বাধ্য নয়। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত চুক্তি থাকলেও সেখানে এমন কিছু শর্ত রয়েছে, যার জন্য নয়াদিল্লি সেটি মানতে বাধ্য নয়।” প্রত্যর্পণ চুক্তির ওই শর্তের কথা বলে হাসিনাকে প্রত্যর্পণে ভারত বাধ্য নয় বলে জানান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমনকল্যাণ লাহিড়ীও। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী বলেন, “ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ নিয়ে চুক্তি রয়েছে। কিন্তু সোমবারের রায়ের পর বাংলাদেশে হাসিনার প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ওই চুক্তিতে থাকা নিয়ম অনুসারেই ভারত হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য নয়।”
এই প্রসঙ্গে আইনগত দিকটি ব্যাখ্যা করে কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী অরিন্দম দাস বলেন, “হাসিনা এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন। কিন্তু দেশে না-থাকার জন্য হাসিনাকে যদি তা করতে বাধা দেওয়া হয়, তবে তা মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।” একই সঙ্গে তিনি জানান, ট্রাইবুনালের রায়ের প্রতিলিপি পাঠানো হলেও ভারত তা মানতে বাধ্য নয়। তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, যদি কোনও দেশে কারও জীবনের ঝুঁকি থাকে, তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়া দেশ তাঁকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য নয়। হাসিনার ক্ষেত্রেও এই আইনের কথা তুলে ধরতে পারে ভারত।”
কী বলছে ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি
২০১৩ সালে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন কেন্দ্রে মনমোহন সিংহের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। অন্য দিকে, ঢাকার মসনদে হাসিনাই। সেই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, আদালতের রায়ে প্রত্যর্পণ করানোর মতো অপরাধ করে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এক দেশ অপর দেশের হাতে তুলে দেবে। এই বিষয়ে সবিস্তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছিল, ন্যূনতম এক বছরের জেল হতে পারে, এমন অপরাধ করে থাকলে সেই ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করা হবে। এ-ও বলা হয়েছিল যে, সেই অপরাধকে চুক্তি স্বাক্ষর করা দুই দেশেই শাস্তিযোগ্য হতে হবে। অপরাধে প্ররোচনা দেওয়া বা সাহায্য করা ব্যক্তিকেও প্রত্যর্পণ করা যেতে পারে বলে জানানো হয়। ২০১৬ সালে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করতে চুক্তি সংশোধন করা হয়। সংশোধিত চুক্তিতে বলা হয়, কারও নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেই তাঁকে প্রত্যর্পণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অপরাধের প্রমাণস্বরূপ কোনও তথ্যপ্রমাণ দাখিল করতে হবে না। হাসিনার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। সংশোধিত চুক্তি অনুসারেই তাঁকে প্রত্যর্পণ করার আর্জি জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
কোন কোন ক্ষেত্রে প্রত্যর্পণ হবে না
চুক্তিতে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে, অপরাধটির যদি রাজনৈতিক চরিত্র থাকে, তা হলে প্রত্যর্পণ করা হবে না। খুন, গুম করা এবং অত্যাচার (যেগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি হাসিনা অভিযুক্ত) রাজনৈতিক অপরাধের তালিকায় রাখা হবে না বলেও চুক্তিতে বলা হয়েছে। চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, সেখানে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে যে, বিচারের নেপথ্যে যদি সৎ কোনও উদ্দেশ্য না-থাকে, তা হলে ভারত বা বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করবে না। হাসিনাকে প্রত্যর্পণ না-করার জন্য এই যুক্তিগুলি খাড়া করতে পারে ভারত। হাসিনা নিজেও বারবারই তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। বিচারের নামে প্রহসনের অভিযোগও তুলেছেন।
কেন এই চুক্তি করা হয়েছিল?
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় গা ঢাকা দেওয়া অপরাধীদের নাগাল পেতেই প্রত্যর্পণ চুক্তি করেছিল ভারত এবং বাংলাদেশ। সেই সময় (২০১৩ সাল) উত্তর-পূর্ব ভারতে অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পরিকল্পনা নিয়ে বেশ কয়েক জন উগ্রপন্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছিল। আবার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের রাজ্যগুলিতে জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি-র সদস্যরা ঘাঁটি গেড়েছে বলে খবর মেলে। উভয় দেশে আশ্রয় নেওয়া অপরাধীদের প্রত্যর্পণ করার জন্যই এই চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারত এবং বাংলাদেশ।
বস্তুত, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের জেরে ২০২৪ সালের অগস্ট মাসে ক্ষমতাচ্যুত হন সে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। পতন হয় তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সরকারের। ৫ অগস্ট বাংলাদেশ ছাড়েন হাসিনা এবং আশ্রয় নেন ভারতে। তার পর থেকে তিনি ভারতেই রয়েছেন।