যতটা নাটক, ভারত-পাক মৈত্রী ততটা দৃঢ় হচ্ছে কি?

এ বার বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যখন পাকিস্তান গিয়েছিলেন, তখন শুধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নন, তাঁর স্ত্রী, মা, এমনকী কন্যা ও নাতি-নাতনি পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। সবাই মিলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এক জব্বর আড্ডা হয়। সুষমা উর্দুতে কথা বলেছিলেন।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৫:৩৫
Share:

পাশাপাশি দুই নেতা। ছবি: পিটিআই।

এ বার বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যখন পাকিস্তান গিয়েছিলেন, তখন শুধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নন, তাঁর স্ত্রী, মা, এমনকী কন্যা ও নাতি-নাতনি পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। সবাই মিলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এক জব্বর আড্ডা হয়। সুষমা উর্দুতে কথা বলেছিলেন। ভারতের মহিলা বিদেশমন্ত্রীর মুখে উর্দু শুনে নওয়াজের মা তো বলেন, এমন সুন্দর উর্দু শিখলে কী করে? সুষমা তাঁদের বলেন, বাবা উর্দু পড়তে-লিখতে আর বলতে পারতেন।

Advertisement

হরিয়ানার মেয়ে সুষমা তাঁর মেয়েবেলায় বাবার সঙ্গে অনেক সময়েই উর্দু ভাষায় কথা বলতেন। তা ছাড়া সুষমার বক্তব্য: উর্দু তো ভারতীয় ভাষাও।

সুষমা প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো একটা দারুণ কাশ্মীরী শাল উপহার দিলেন নওয়াজকে। সেই শালটি সঙ্গে সঙ্গে গায়ে জড়িয়ে নানা ধরনের হিন্দি বলিউডি পুরনো ছবির গানের লাইন আওড়াতে লাগলেন। গলায় সুর নেই তবু গাওয়ার চেষ্টা করছেন। নাতি-নাতনিরা সুষমাকে জড়িয়ে ছবি তুললেন। আর তাঁদের ঠাকুমা পঞ্জাবি ভাষায় বললেন, পুত্তুর নরেন মোদীকে এক বার আসতে বলো এ শহরে। ওকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো। সুষমাও নরেন্দ্র মোদীর মতো নিরামিষাশী। ওঁর জন্য পনির থেকে সর্ষের শাক, বেগুন ভর্তা— অসাধারণ অতিথি বৎসলতা! সুষমাও এ সব দেখে চোস্ত পঞ্জাবি ভাষাতেই কথা শুরু করে দেন, উর্দু ছেড়ে। হরিয়ানার মেয়ে সুষমা যে এত ভাল পঞ্জাবি ভাষা জানেন তা-ও জানতেন না নওয়াজ। মধুরেণ সমাপয়েত। তখনই সুষমা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসে জানান, নওয়াজ চাইছেন এক বার আসুন ইসলামাবাদ।

Advertisement

আরও পড়ুন:
শুভ জন্মদিন নওয়াজ, দিল্লি ফেরার পথে মোদী হঠাৎ লাহৌরে
ছিল না প্রত্যাশার চাপ, তাই আলোচনা এগোল খোলা মনে
আগামী মাসে ফের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বসছে ভারত-পাক

হঠাৎ পাক সফর, মার্কিন মিডিয়ার চোখে ‘হিরো’ মোদী

কিন্তু নরেন্দ্র মোদী যে এত তাড়াতাড়ি নাটকীয় ভাবে ইসলামাবাদ চলে যাবেন সেটা কিন্তু সুষমা, এমনকী, বিদেশ মন্ত্রকও জানত না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদীর সঙ্গে নওয়াজের এই নিয়ে ছ’বার বৈঠক হল। প্রথমেই শপথ গ্রহণের সময় তিনি নওয়াজকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানান। তার পর নিউইয়র্ক, নেপালে সার্কের সময়, তার পর রাশিয়ায় জি-৮-এর সম্মেলনের সময় উফায়, তার পর প্যারিস, এ বার তো লাহৌর।

প্রশ্ন হচ্ছে, এত ঘন ঘন নওয়াজের সঙ্গে বৈঠক করে সত্যি সত্যি কি কোনও লাভ আছে? বিদেশসচিব জয়শঙ্কর আগামী মাসে পাক বিদেশ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করতে যাচ্ছেন, তারপর ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলনও হবে। কিন্তু বিদেশ সচিবেরও অভিমত হল, নওয়াজ আর কবে ভাল ভাল কথা বলেন না? কিন্তু ভারত-পাক সম্পর্কের কূটনৈতিক ভবিষ্যতের চাবিকাঠি কি তাঁর হাতে আছে? এই চাবিকাঠি তো পাক সেনাবাহিনী আইএসআই আর মোল্লাতন্ত্রের হাতেই ন্যস্ত। নওয়াজের জন্মদিনে মোদীর বৈঠকের পরেই জঙ্গি নেতা হাফিজ সঈদ নওয়াজকে আক্রমণ করেছেন। তিনি বলেছেন, শত্রুকে কেন নওয়াজ এ ভাবে বাড়িতে স্বাগত জানাচ্ছেন?

আসলে পাকিস্তান কোনও দিনই তো একটা পাকিস্তান নয়। অটলবিহারী বাজপেয়ীও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তাঁর প্রথম বিদেশ সফর কলম্বোতে সার্ক সম্মেলনে নওয়াজের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন সমুদ্রতীরে তাজ-সমুদ্র হোটেলে। সে দিন ছিলাম সেই বৈঠকের সময়। নওয়াজ তখনও বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চান তিনি। আসলে পাকিস্তানে তিনি পঞ্জাবি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। আর পাক সম্মেলনে পঞ্জাবের প্রতিনিধিরাই সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। এর পর বাজপেয়ী নিউইয়র্কে সেপ্টেম্বর মাসে আবার নওয়াজের সঙ্গে বৈঠক করেন। নিউইয়র্ক প্যালেস হোটেলে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে হাজির ছিলাম। দেখেছিলাম, কী ভাবে তাঁরা লাহৌর বাসযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু তার পর লাহৌর যাত্রার পর পারভেজ মুশারফের সামরিক অভ্যুত্থান থেকে আগ্রা বৈঠক, প্রতিটি ঘটনায় মনে পড়ে নওয়াজ কী ভাবে পাকিস্তান থেকেই বিতাড়িত হলেন।

এটাই হল পাকিস্তান। এ বার অবশ্য নাটক যা-ই হোক না কেন, নওয়াজ অনেক সতর্ক। মোদীও বাজপেয়ীর পথে হাঁটতে চাইলেও কারগিল বিস্মৃত হতে পারেন না। তাই নাটক যতটা হচ্ছে ঠিক ততটা কাশ্মীর সূত্র সমাধান নিয়ে এগোনোর চেষ্টা নেই।

আসলে মোদী এই পাকিস্তান মৈত্রীর বার্তা দিয়ে অমিত শাহের মেরুকরণের রাজনীতির বার্তায় পরিবর্তন আনতে চাইছেন। গোটা দেশ জুড়ে যে অসহিষ্ণুতার আবহ তৈরি হয়েছে, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজে যে সঙ্ঘ বিরোধী প্রতিক্রিয়া, সে সবকে বদলে রাজধর্ম পালনের বার্তা দিতে ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন তিনি। তবে এ কাজেও সমালোচনার ঝড় উঠছে।

সমালোচনা
১) মোদী নিজেই বলেছিলেন, চিন মডেল অনুসরণ করে এগোনো ভাল। কথাবার্তা হোক, কিন্তু মৈত্রী নিয়ে অতিনাটকীয়তা এবং অতি গুরুত্ব প্রদান না করাই শ্রেয়। মোদী নিজেই তা মানছেন না।

২) হুরিয়ত নেতারা পাক হাইকমিশনে এসেছিলেন বলে মোদী বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করে দেন। আবার এখন কূটনৈতিক ডিগবাজি খেয়ে অতি-বন্ধুত্বর পথে এগোচ্ছেন তিনি। এটা মার্কিন চাপে কি না, সে প্রশ্নও নিন্দুকেরা তুলছেন।

৩) শিবসেনা ও সঙ্ঘ পরিবারের একাংশ এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ। সন্ত্রাস বন্ধ হবে ভারতে? দাউদকে ফেরত পাওয়া যাবে? এ সব প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।

মোদীকে এই অতি-উগ্র হিন্দুত্ববাদীদেরও সামলাতে হবে। এই প্রশ্নগুলিকে আগামী দিনে মোদী কী ভাবে মোকাবিলা করবেন, সেটাই দেখার বিষয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন