বামপন্থীরা বণিকসভার বার্ষিক সম্মেলনে হাজির হয়েছেন, এমন দৃশ্য বিরল। হাজির হলেও এমন সভায় আর্থিক সংস্কারের বিরোধিতা করার কারণ ব্যাখ্যা করতেই জেরবার হতে হয় বামপন্থীদের। সীতারাম উল্টো ঘটল ইয়েচুরির ক্ষেত্রে। কিংবা বলা যায় উল্টোটা ঘটালেন তিনি। বণিকসভা সিআইআই-এর বার্ষিক সম্মেলনে আজ স্বচ্ছন্দে হাজির হলেন তিনি। প্রশ্ন করা হল, আপনি এই মুহূর্তে দেশের অর্থমন্ত্রী হলে কী করবেন? জবাব দিয়ে হাততালিও কুড়োলেন এই কমিউনিস্ট নেতা।
সিআইআই-এর সম্মেলনে আজ সকাল থেকে অরুণ জেটলি, এম বেঙ্কাইয়া নায়ডুর মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা মোদী সরকারের নীতি ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক সংস্কারের কথা। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিরোধিতায় যে সংসদে জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধনের মতো সংস্কার আটকে রয়েছে, সে কথাও তুলে ধরেছেন তাঁরা। এই সম্মেলনেই বিকেলের দিকে বিতর্ক-পর্বে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ইয়েচুরিকে। বিতর্কের বিষয়, জাতীয় স্বার্থ কি রাজনৈতিক স্বার্থের চেয়ে প্রাধান্য পেতে পারে?
ইয়েচুরি প্রথমেই জানিয়ে দেন, বিরোধিতার জন্য সব থেকে বেশি কালিমালিপ্ত হতে হয় বামপন্থীদের। হরতাল-ধর্মঘটের জন্য তাঁদেরই দোষ দেওয়া হয়। কোনও শিল্পপতিই বুঝতে চান না যে, শ্রমিকরা নেহাত নিরুপায় না হলে ধর্মঘটে যান না। কোনও শ্রমিকই চান না তাঁর কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাক।
প্রশ্ন ওঠে, সব ক্ষেত্রে বামেদের বেসরকারিকরণ-বিরোধিতা নিয়ে। জানতে চাওয়া হয়, সিপিএম কেন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারি হস্তক্ষেপের দাবি তোলে? এক শিল্পকর্তার প্রশ্ন করেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে যে ভাল চিকিৎসা মেলে না, সরকারি স্কুলে যে ভাল পড়াশোনা হয় না, তা প্রমাণিত। তার পরেও এই সব ক্ষেত্রে বামপন্থীরা কেন সরকারি হাসপাতাল বা স্কুল তৈরির কথা বলেন?’’ অন্য যে কোনও কমিউনিস্ট নেতা হলে এ ক্ষেত্রে হয়তো চিনের উদাহরণ টানতেন। ইয়েচুরি যুক্তি দিলেন আমেরিকা-ইউরোপের তুলনা টেনে। মনে করিয়ে দেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলিতে সরকারই সকলের জন্য উন্নত মানের শিক্ষার বন্দোবস্ত করেছে। আমেরিকাতেই একশো ভাগ সরকারি অর্থে সড়ক ও অন্যান্য পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে। তার ভিতে দাঁড়িয়েই বেসরকারি সংস্থাগুলি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। সমালোচনার মোকাবিলায় পাল্টা আক্রমণেও গিয়েছেন ইয়েচুরি। তবে বামেদের কোনও নীতি বা আদর্শের প্রসঙ্গ টেনে নয়, সিআইআই-এর তথ্য তুলে ধরেই তিনি বুঝিয়েছেন, শিল্প-বাণিজ্যের নিজস্ব সঙ্কটের জন্য বাম বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে দোষ দেওয়া যায় না। তিনি প্রশ্ন করেন, আপনাদের তথ্যই বলছে, সব কারখানায় এক বছরের জন্য পণ্য তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমছে। কী করবেন উৎপাদিত পণ্য নিয়ে? কোথায় বেচবেন? তিনি যুক্তি দেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দা। দেশেও চাহিদা বাড়ছে না। সেই কারণেই কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধির হার ক্রমশ কমছে।
ইয়েচুরির যুক্তি ফেলে দিতে পারেননি শিল্পকর্তারা। তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়েছেন, আপনি এখন অর্থমন্ত্রী হলে আপনার প্রথম ৩টি কাজ কী হবে? ইয়েচুরি বলেন, এক, প্রত্যেক বছর বাজেটে যে বিপুল পরিমাণ অনাদারী করের হিসেব দেওয়া হয়, সেই কর আদায় করা হবে। তাতে রাজকোষের কোনও ঘাটতিই থাকবে না। দুই, ওই টাকা আর্থিক ও সামাজিক পরিকাঠামো তৈরিতে ব্যয় করা হবে। তিন, এর ফলে যে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে, তা থেকেই মানুষের কেনার ক্ষমতা বাড়বে। বাজারে চাহিদা তৈরি হবে। বাড়বে কারখানার উৎপাদন।
একশো ভাগ কর আদায়ের কথা বলা আর বাস্তবে করে দেখানোর মধ্যে যে অনেক ফারাক, সেটা বিতর্কসভায় উপস্থিত শিল্পপতিরা ভালই জানেন। তবু তাঁরা স্বাগত জানালেন কমিউনিস্ট নেতার বক্তব্যকে।
শুধু হাততালি কুড়োননি, ইয়েচুরি এ দিন এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, কমিউনিস্ট হলেও তিনি বণিকসভায় যেতে বা শিল্পপতিদের মুখোমুখি হতে পিছপা নন। সিপিএমের নেতারাও বলছেন, মানসিকতায় এই ধরনেরই বদল প্রয়োজন। আগামী সপ্তাহে বিশাখাপত্তনমে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস। সাধারণ সম্পাদক পদের অন্যতম দাবিদার ইয়েচুরি। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, বণিকসভার হাজির হয়ে কি দলেও কোনও বদলের বার্তা দিলেন তিনি? উত্তর দেননি ইয়েচুরি।