সুপ্রিম কোর্টে ওয়াকফ মামলা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
মঙ্গলবার থেকে পর পর তিন দিন ওয়াকফ মামলা শুনল সুপ্রিম কোর্ট। সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় নিজেদের বক্তব্য জানান মামলাকারীরা। কেন্দ্রের তরফেও নিজেদের অবস্থান জানানো হয় সুপ্রিম কোর্টে। তিন দিন ধরে সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পর অন্তর্বর্তী রায়দান স্থগিত রেখেছে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি বিআর গবই এবং বিচারপতি অগাস্টিন জর্জ মাসিহর বেঞ্চ।
বৃহস্পতিবার মামলার শুরুতেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জানিয়ে দেন, সংশোধিত ওয়াকফ আইনের উপর স্থগিতাদেশ জারি হবে কি না, শুধু সেটিই আদালত বিবেচনা করছে। কেন স্থগিতাদেশ জারি করা উচিত নয়, তা নিয়ে সওয়াল করেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। তাঁর বক্তব্য, কোনও প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে বলে এই নয় যে শুধু সেই কারণের জন্য আইনসভায় পাশ হওয়া একটি আইনের উপর স্থগিতাদেশ দেওয়া যায়।
মামলাকারী পক্ষের অন্যতম অভিযোগ হল, সংশোধিত আইনের মাধ্যমে অমুসলিমদের ওয়াকফ তৈরির অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যদিও সলিসিটর জেনারেলের বক্তব্য, ওয়াকফ তৈরি করা এবং ওয়াকফে সম্পত্তি দান করা ভিন্ন বিষয়। মেহতার সওয়াল, যদি কোনও হিন্দু মসজিদ তৈরি করতে চান, তবে ওয়াকফ তৈরির কী দরকার? তিনি তো ট্রাস্ট তৈরি করেই সেটি করতে পারেন।
বুধবারের শুনানির সময় ওয়াকফ বোর্ডের সঙ্গে হিন্দুদের দেবোত্তর সম্পত্তি বোর্ডের ফারাক বোঝাতে গিয়ে মেহতা দাবি করেছিলেন, হিন্দুদের দেবোত্তর বোর্ডগুলি শুধু ধর্মীয় কাজের সঙ্গেই যুক্ত। তবে ওয়াকফ বোর্ড বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ কাজও করে। হিন্দু দেবোত্তর বোর্ড নিয়ে ওই মন্তব্য যে ভুল ছিল, তা বৃহস্পতিবারের শুনানিতে মেনে নিলেন কেন্দ্রের আইনজীবী। এজলাসে মেহতা বলেন, “আমি গতকাল একটি ভুল মন্তব্য করেছিলাম। হিন্দুদের দান সংক্রান্ত বোর্ডগুলি ধর্মীয় এবং দানমূলক উভয় কাজই করে। আমি বলেছিলাম, শুধু ধর্মীয় কাজের সঙ্গে যুক্ত।”
বৃহস্পতিবারের শুনানির দ্বিতীয়ার্ধে মামলাকারী পক্ষকে প্রধান বিচারপতি জানান, এই আইনের উপর স্থগিতাদেশ চাইলে, আদালতের কাছে তার কারণ স্পষ্ট করতে হবে। মামলাকারী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী রাজীব ধাওয়ান জানান, ওয়াকফ যে অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য, তা প্রতিষ্ঠিত। এটি দানের অংশ, যা ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। অপর আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি জানান, মেহতার বক্তব্য অনুসারে ২৮টি রাজ্যের মধ্যে পাঁচটিতে এবং আটটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে চারটিতে সমীক্ষা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান দেশের মাত্র ৯ শতাংশ অঞ্চলের বলে দাবি সিঙ্ঘভির। সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পর রায়দান স্থগিত রেখেছে আদালত।
বৃহস্পতিবারের শুনানি শেষ হল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির এজলাসে। পর পর তিন দিন ধরে সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে অন্তর্বর্তী রায়দান স্থগিত রাখল সুপ্রিম কোর্ট।
মামলাকারী পক্ষের আইনজীবী এএম দারের বক্তব্য, ওয়াকফ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘ওয়াকাফা’ থেকে, যাঁর অর্থ বন্ধন। তাঁর কথায়, কোনও ব্যক্তি যত বেশি ওয়াকফে সম্পত্তি দেন, তত বেশি ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছে যান।
সলিসিটর জেনারেল এর আগে যৌথ সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে মামলাকারী পক্ষের আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি জানান, মেহতার বক্তব্য অনুসারে ২৮টি রাজ্যের মধ্যে পাঁচটিতে এবং আটটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে চারটিতে সমীক্ষা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান দেশের মাত্র ৯ শতাংশ অঞ্চলের বলে দাবি সিঙ্ঘভির।
মামলাকারী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী রাজীব ধাওয়ান জানান, ওয়াকফ যে অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য, তা প্রতিষ্ঠিত। এটি দানের অংশ, যা ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম।
সিব্বলের বক্তব্য, ওয়াকফ হল ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গ করা সম্পত্তি। সে কথা শুনে প্রধান বিচারপতি জানান, অন্য ধর্মের ক্ষেত্রেও একই ধরনের (দানমূলক) আইন রয়েছে। তাতে সিব্বল জানান, “অন্য (আইনের) ক্ষেত্রে তা সম্প্রদায়ের প্রতি দান। এ ক্ষেত্রে ঈশ্বরের প্রতি দান। এক বার দান করা হলে সেটি আর ফেরত নেওয়া যায় না।”
মামলাকারী পক্ষের আইনজীবী কপিল সিব্বল আদালতে সওয়াল করেন, “একটি সম্পত্তি সরকারি সম্পত্তি কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন একজন কালেক্টর। তার পরে বলা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত সম্পত্তিটি ওয়াকফ হিসাবে গণ্য হবে না। কোন আইন অনুসারে এটি প্রমাণ করা যেতে পারে?”
ওয়াকফ মামলায় সওয়ালের একটি পর্যায়ে কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা জানান, বুধবারের সওয়ালে তিনি একটি ভুল মন্তব্য করেছিলেন। বুধবার মেহতা জানিয়েছিলেন, ওয়াকফ বোর্ডের ভূমিকা ধর্মনিরপেক্ষ। সেই প্রসঙ্গেই ওয়াকফের সঙ্গে হিন্দুদের দানের সম্পত্তির ফারাক বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “হিন্দুদের দান সংক্রান্ত বোর্ড শুধুমাত্র ধর্মীয় কাজের সঙ্গে যুক্ত। তবে ওয়াকফের সম্পত্তি বিভিন্ন ধর্মনিরেপক্ষ কাজেও ব্যবহার হয়।” ওই মন্তব্য যে ভুল ছিল, তা বৃহস্পতিবার আদালতে মেনে নেন মেহতা। সলিসিটর জেনারেল বলেন, “আমি গতকাল একটি ভুল মন্তব্য করেছিলাম। হিন্দুদের দান সংক্রান্ত বোর্ডগুলি ধর্মীয় এবং সেবামূলক উভয় কাজই করে। আমি বলেছিলাম, শুধু ধর্মীয় কাজ।”
তৃতীয় দিনের শুনানির দ্বিতীয় ভাগে মামলাকারী পক্ষের বক্তব্য শোনা শুরু করল সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপিত গবই দ্বিতীয়ার্ধের শুনানির শুরুতেই মামলাকারী পক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন, “আপনাদের এই বিষয়টি আদালতকে সন্তুষ্ট করতে হবে যে, আইনটি এতটাই (স্বেচ্ছাচারী) যে সেটিকে স্থগিত রাখা উচিত।”
সলিসিটর জেনারেলের বক্তব্য, ওয়াকফ তৈরি করা এবং ওয়াকফে সম্পত্তি দান করা ভিন্ন বিষয়। তিনি বলেন, “সেই কারণে মুসলিমদের জন্য পাঁচ বছরের ধর্মপালনের কথা বলা হয়েছে। যাতে কাউকে প্রতারিত করতে ওয়াকফের ব্যবহার না-হয়। ধরে নেওয়া যাক, আমি হিন্দু হিসাবে ওয়াকফের জন্য কিছু দান করতে চাই, সেটি করাই যেতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “একজন অমুসলিম কী ভাবে ওয়াকফ তৈরি করতে পারেন? তিনি চাইলে ওয়াকফকে সম্পত্তি দান করতে পারেন।”
মামলাকারী পক্ষের অন্যতম অভিযোগ হল, সংশোধিত আইনের মাধ্যমে অমুসলিমদের ওয়াকফ তৈরির অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যদিও মেহতার বক্তব্য, ১৯২৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত যে কোনও মুসলিম ওয়াকফ তৈরি করতে পারতেন। ২০১৩ সালের আইনে ‘মুসলিম’ শব্দটি বদলে ‘যে কোনও ব্যক্তি’ যুক্ত করা হয়েছে। সলিসিটর জেনারেল আদালতে জানান, যদি কোনও হিন্দু সত্যিই ওয়াকফের জন্য সম্পত্তি দিতে চান, তিনি কোনও ট্রাস্ট তৈরি করতে পারেন। সেবামূলক পদক্ষেপ হিসাবে মসজিদ তৈরি করতে পারেন। যদি কোনও হিন্দু মসজিদ তৈরি করতে চান, তবে ওয়াকফ তৈরির কী দরকার? তিনি তো ট্রাস্ট তৈরি করেই সেটি করতে পারেন।
কেন আইনের উপর স্থগিতাদেশ জারি করা উচিত নয়, তা নিয়ে কেন্দ্রের তরফে শীর্ষ আদালতে সওয়াল করেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। তাঁর বক্তব্য, কেউ কোনও প্রস্তাব উত্থাপন করতেই পারেন। সেটি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে বলে এই নয় যে শুধু সেই কারণের জন্য আইনসভায় পাশ হওয়া একটি আইনের উপর স্থগিতাদেশ দেওয়া যায়।
বৃহস্পতিবার মামলার শুরুতেই প্রধান বিচারপতি গবই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ২০২৫ সালের সংশোধিত ওয়াকফ আইনের উপর স্থগিতাদেশ জারি হবে কি না, শুধু সেটিই আদালত বিবেচনা করছে।
এই নিয়ে টানা তিন দিন ধরে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলছে সংশোধিত ওয়াকফ আইন সংক্রান্ত মামলার। মঙ্গলবার এবং বুধবার দীর্ঘ সময় ধরে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি বিআর গবইয়ের বেঞ্চ মামলাটি শুনেছে। মঙ্গলবার মামলাকারী পক্ষের বক্তব্য শোনা হয়েছে। বুধবার আদালত শুনেছে কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য। মামলাকারী আইনজীবীদের বেশ কিছু বক্তব্যের বিরোধিতাও উঠে এসেছে সলিসিটর জেনারেলের সওয়ালে। সংশোধিত ওয়াকফ আইনের ৩ডি নম্বর ধারা মূল বিলে ছিল না বলে যে অভিযোগ মামলাকারীরা তুলেছেন, সেটিরও বিরোধিতা করেছেন তিনি।