সুপ্রিম কোর্টে ওয়াকফ মামলা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ শুনানি চলল মঙ্গলবার। সকাল সাড়ে ১১টার কিছু পরে মামলার শুনানি শুরু হয় শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি বিআর গবই এবং বিচারপতি অগাস্টিন জর্জ মাসিহ-র বেঞ্চে। মাঝে কিছু ক্ষণের বিরতি। তার পর আবার শুনানি। চলল প্রায় বিকেল ৪টে পর্যন্ত।
প্রায় চার ঘণ্টার কিছু কম সময় ধরে মামলাকারী পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শুনল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। প্রশ্ন উঠল, নতুন আইনের ৩ডি ধারার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। ওই ধারাটির উপর সম্পূর্ণ স্থগিতাদেশ জারির আর্জিও উঠল। তবে মঙ্গলবার দীর্ঘ শুনানির পর আগের নির্দেশই বহাল রয়েছে। আগামিকাল, বুধবার ফের মামলার শুনানি হবে।
আইনজীবী কপিল সিব্বলের অভিযোগ, ৩ডি-সহ আইনের দু’টি ধারা মূল বিলের অংশ ছিল না। এমনকি যৌথ সংসদীয় কমিটিতেও এই নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। সংসদে ভোটাভুটির আগে ওই ধারা দু’টি সংযোজিত হয়েছে বলে দাবি তাঁর। একই অভিযোগ তুললেন মামলাকারী পক্ষের অপর আইনজীবী হাফেজ়া আহমদিও। তাঁরও বক্তব্য, “আইনের ৩ডি ধারার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। বহু পুরনো মসজিদে এর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” এই ধারার উপর স্থগিতাদেশের আর্জি জানান তিনি।
ওয়াকফকে সম্পত্তি দানের ক্ষেত্রে কেন পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালনের শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে আদালতে। সিব্বল বলেন, “যদি কেউ মৃত্যুশয্যায় শায়িত থাকেন এবং ওয়াকফকে সম্পত্তি দান করতে চান, তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি মুসলিম ধর্ম পালন করছেন! এটি তো অসাংবিধানিক।” এই নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী আহমেদিও। তাঁরও প্রশ্ন, কেউ পাঁচ বছর ইসলাম ধর্ম পালন করছেন কি না, তা যাচাই করার মাপকাঠি কোথায় উল্লিখিত রয়েছে?
সম্প্রতি বিভিন্ন মহলে দাবি করা হয়েছে, ওয়াকফের সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তথ্য কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। তাঁর বক্তব্য, ২০১৩ সাল থেকে ওয়াকফগুলি একটি পোর্টালে নিবন্ধীকরণ শুরু হয়েছিল। পোর্টালের তালিকায় সেই বৃদ্ধিকে ওয়াকফের পরিমাণ বৃদ্ধি বলে কেন্দ্র দেখাতে চাইছে বলে দাবি সিঙ্ঘভির। যৌথ সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “২৮টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র ৫টি রাজ্যে সমীক্ষা হয়েছে। ৯.৩ শতাংশ সমীক্ষা হয়েছে।”
সংশোধিত ওয়াকফ আইনের ৩ডি ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন মামলাকারী পক্ষের অপর আইনজীবী হাফেজ়া আহমদিও। তাঁরও বক্তব্য, “আইনের ৩ডি ধারার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। বহু পুরনো মসজিদে এর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” আইনের এই ধারার উপর সম্পূর্ণ স্থগিতাদেশের আর্জি জানান তিনি। ওয়াকফের সম্পত্তি দানের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর ইসলাম ধর্ম পালনের যে শর্তের কথা উল্লেখ রয়েছে আইনে, তা নিয়েও প্রশ্ন আহমেদির। কেউ পাঁচ বছর ইসলাম ধর্ম পালন করছেন কি না, তা যাচাই করার মাপকাঠি কোথায় উল্লিখিত রয়েছে? প্রশ্ন আইনজীবীর।
ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ কি আদৌ বৃদ্ধি পেয়েছে? সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। তাঁর বক্তব্য, ২০১৩ সাল থেকে ওয়াকফগুলি একটি পোর্টালে নিবন্ধীকরণ শুরু হয়েছিল। পোর্টালের তালিকায় সেই বৃদ্ধিকে ওয়াকফের পরিমাণ বৃদ্ধি বলে কেন্দ্র দেখাতে চাইছে বলে দাবি সিঙ্ঘভির। যৌথ সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “২৮টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র ৫টি রাজ্যে সমীক্ষা হয়েছে। ৯.৩ শতাংশ সমীক্ষা হয়েছে।”
ধওয়ান বলেন, “আমরা এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বাস করি। আমার এক মক্কেল আছেন, তিনি শিখ। তিনি বলছেন, ওয়াকফে সম্পত্তি দিতে চান। আমি আশা করি ওই সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হবে না।”
সিব্বলের সওয়ালের রেশ ধরেই সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রশ্ন তোলেন মামলাকারী পক্ষের অপর আইনজীবী রাজীব ধওয়ান। তাঁর বক্তব্য, ধর্মীয় সম্পত্তির বিষয়ে এ ভাবে ব্যাখ্যা আগে কখনও করা হয়নি। তিনি বলেন, “ব্রিটিশেরাও ধর্মীয় সম্পত্তির সংজ্ঞা পরিবর্তন করেনি। ওয়াকফের ধারণার এই ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ কী ছিল?”
ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলিম সদস্যদের কেন রাখা হচ্ছে, তা নিয়ে আবারও আদালতে প্রশ্ন তোলেন সিব্বল। তাঁর বক্তব্য, আগে এই কাউন্সিলে সকলেই মুসলিম ছিলেন, কিন্তু এখন সিংহভাগ সদস্যই অমুসলিম রাখার কথা হচ্ছে। এই অবস্থায় বুদ্ধগয়ার প্রসঙ্গ তোলেন প্রধান বিচারপতি। তাঁর প্রশ্ন, “বুদ্ধগয়া নিয়ে কী বলবেন? সেখানে তো সকলে হিন্দু।” তখন সিব্বলের বক্তব্য, “কারণ, সেটি হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয়েরই উপাসনাস্থল। বুদ্ধগয়া আইনেও এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। আমি জানতাম আপনি এই প্রশ্ন করবেন।”
আইনের দু’টি ধারার প্রসঙ্গে সিব্বলের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি গবই জানতে চান, সংসদেও এই নিয়ে আলোচনা হয়নি? বিচারপতি মাসিহও বলেন, “সংসদে তো ভোটাভুটি হয়েছিল।” তখন সিব্বল জানান, নিশ্চয়ই ভোটাভুটির ঠিক আগে এটি যুক্ত করা হয়েছিল।
বিরতির পর প্রধান বিচারপতির এজলাস বসলে আবার সওয়াল শুরু করেন সিব্বল। আদালতে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া একটি তালিকা দেখিয়ে তিনি বলেন, “একবার সম্পত্তিগুলি সংরক্ষিত হয়ে গেলে সেগুলির আর ওয়াকফ বলে বিবেচিত হবে না। এর মধ্যে সম্ভলের জামা মসজিদও রয়েছে। কোথাও কোনও দ্বন্দ্ব তৈরি হলেই সেটিকে আর ওয়াকফ বলে বিবেচনা হবে না। যে তালিকাটি রয়েছে সেটিও সম্পূর্ণ নয়।” পাশাপাশি নতুন আইনের ৩ডি এবং ৩ই ধারায় যেগুলির উল্লেখ রয়েছে, প্রকৃত বিলে সেগুলির উল্লেখ ছিল না বলেও দাবি সিব্বলের। তাঁর বক্তব্য, যৌথ সংসদীয় কমিটিতেও এগুলি নিয়ে আলোচনা হয়নি।
শুনানির একটি পর্যায়ে সিব্বল জানান, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য কখনওই ছিল না ওয়াকফ সংক্রান্ত আগের আইনগুলিতে। কিন্তু ২০২৫ সালের নতুন আইনে সেটির সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে বলে জানান সিব্বল।
সিব্বলের বক্তব্য, “নতুন আইন অনুসারে ওয়াকফকে সম্পত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত চাপানো হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সম্পত্তি দানের আগে পাঁচ বছর মুসলিম ধর্ম পালন করতে হবে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কে নেবেন? যদি কেউ মৃত্যুশয্যায় শায়িত থাকেন এবং ওয়াকফকে সম্পত্তি দান করতে চান, তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি মুসলিম ধর্ম পালন করছেন! এটি তো অসাংবিধানিক।”
শুনানিতে সিব্বল জানান, এই আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের সিংহভাগ সদস্যকেই অমুসলিম রাখার কথা বলা হচ্ছে। নতুন আইনের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কাউন্সিলে মুসলিম সদস্য থাকবেন ১০ জন এবং অমুসলিম সদস্য থাকবেন ১২ জন। আগে সকলেই মুসলিম ছিলেন।
আগের আইনের থেকে বর্তমানের আইনের ফারাক বোঝাতে গিয়ে সিব্বল জানান, কোনও প্রাচীন সৌধকে সংরক্ষিত করা হলেও সেটির পরিচয় বদল করা হয়নি আগে। যেটি ওয়াকফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত ছিল, সেটি তেমনই রাখা হয়েছিল। সেটিকে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। সে কথা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, “খাজুরাহো মন্দির একটি প্রাচীন সৌধ হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে। তবু লোকে সেখানে প্রার্থনা করতে যায়।” প্রধান বিচারপতি গবইয়ের প্রশ্ন, “এটি কি আপনার প্রার্থনার অধিকার কেড়ে নিতে পারে?” এই প্রশ্নের জবাবে সিব্বল জানান, ১৯৫৮ সাল অনুসারে যেগুলিকে প্রাচীর সৌধ বা সংরক্ষিত হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলি আর নতুন আইন অনুসারে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য না হলে সেখানে প্রার্থনা করা যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সম্পত্তি দান প্রসঙ্গে সিব্বলের বক্তব্য শুনে প্রধান বিচারপতি গবই বলেন, “এমনটা তো মন্দিরেও হয়। আমি দরগায় যাই, সেখানেও এমন হয়।”
সিব্বল আরও জানান, দেশের সংবিধান অনুসারে কোনও সরকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ দিতে পারে না। মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ দিতে পারে না রাষ্ট্র। ব্যক্তিগত সম্পত্তি দিয়ে একটি কবরস্থান তৈরি করতে হয়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ তাঁদের জীবনের শেষ অধ্যায়ে নিজেদের সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসাবে উৎসর্গ করেন।
সিব্বল বলেন, আইনটি আসলে ওয়াকফ সম্পত্তিকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু ওয়াকফ সম্পত্তিকে দখল করার জন্য আইনটি তৈরি হয়েছে। আইনটি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে কোনও প্রক্রিয়া ছাড়াই ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া যায়। তাঁর বক্তব্য, ওয়াকফ সম্পত্তি হল দান করা সম্পত্তি। এটি অন্য কাউকে হস্তান্তর করা যায় না। এক বার যেটি ওয়াকফ সম্পত্তি হয়ে যায়, সেটি ওয়াকফই থাকে।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি গবই এবং বিচারপতি মাসিহের বেঞ্চে সংশোধিত ওয়াকফ আইন সংক্রান্ত মামলার শুনানি শুরু হয়। পূর্বে যে তিনটি বিষয়ের উপর কেন্দ্র হলফনামা জমা দিয়েছে, সেই বিষয়গুলির উপরেই মামলাকে সীমিত রাখার অনুরোধ করেন সলিসিটর জেনারেল। যদিও তাতে আপত্তি জানান মামলাকারী পক্ষের আইনজীবী কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভিরা।
প্রধান বিচারপতি বিআর গবই এবং বিচারপতি এজি মাসিহের বেঞ্চ গত বৃহস্পতিবার জানায়, ওয়াকফ সংশোধনী আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে যে সব আবেদন জমা পড়েছে আদালতে, তা মঙ্গলবার শোনা হবে। তার পরেই আদালত সিদ্ধান্ত নেবে, সংশোধনী আইনে স্থগিতাদেশ দেওয়া হবে কি না।
সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে মামলার গত বৃহস্পতিবার শুনানির কথা ছিল সুপ্রিম কোর্টে। তবে ওই দিন শুনানি হয়নি। কেন্দ্রের আর্জিতে শুনানির দিন পিছিয়ে মঙ্গলবার করা হয়। তবে গত বৃহস্পতিবারই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছিল, সংশোধিত ওয়াকফ আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে শুনানি হবে মঙ্গলবার।