এত শব্দ কেন? জীবনের ইভিএমে ‘বাটন’ যে শান্তির

শান্তি, নীরবতা ভালবাসেন, ভোট মরসুমের চিল-চিৎকারের সঙ্গে মানিয়ে নেন কী ভাবে?

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৪৯
Share:

ছবি: এপি।

পাক্কা চার ঘণ্টা ডায়ালিসিসের বিছানায় শুয়ে থাকার পরে হাসপাতাল ছাড়তেই মিছিলের মুখোমুখি। বাইক আর মাইকেরও। প্রচারের বাদ্যি, প্রতিশ্রুতি আর ‘এই চিহ্নে ভোট দিন’-এর প্রবল চিৎকারে কেমন যেন মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে সুব্রত দাসের। অসহায় ভাবে বলছিলেন, ‘‘বালাকোট, উন্নয়ন কিচ্ছু চাই না। এই অসুস্থ শরীরে শুধু একটু শান্তি আর নীরবতা চাই জানেন। কিন্তু এই ভোট-বাজারে কেউ তা দেয় না।’’

Advertisement

একই অভিব্যক্তি মাস্কে মুখ ঢাকা ক্যানসার আক্রান্ত তরুণীর। সদ্য যাঁর সাধের লম্বা চুল নিয়ে গিয়েছে কেমোথেরাপি। বেশ বিরক্তি নিয়েই বললেন, ‘‘পাঁচ বছরের জন্য সরকার গড়তে কত লম্বা-চওড়া কথা। কিন্তু আমার মতো যাঁদের সেই পাঁচ বছর আয়ুও ঘোর অনিশ্চিত, তাঁদের এই চিৎকারে বিরক্তি লাগে। ভোট ভাল। প্রচারও জরুরি। কিন্তু আমাদের কথা কি একেবারেই মাথায় রাখা যায় না?’’

দিল্লির লোটাস টেম্পলে দেখা হয়েছিল কে এস আর মূর্তি ও তাঁর স্ত্রী মঞ্জুতাইয়ের সঙ্গে। আদতে অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা। চাকরির খাতিরে থাকেন গুরুগ্রামে। রাজধানীর ওই মন্দিরে একেবারে চুপচাপ, প্রায় পাথরের মূর্তির মতো অন্তত আধ ঘণ্টা বসেছিলেন ওই দম্পতি। চোখ বন্ধ। যেন বিচ্ছিন্ন বাকি পৃথিবীর থেকে। সেখান থেকে বেরোতেই প্রশ্ন করেছিলাম, এই যে এত শান্তি, নীরবতা ভালবাসেন, ভোট মরসুমের চিল-চিৎকারের সঙ্গে মানিয়ে নেন কী ভাবে? উত্তর এল, ‘‘ভোট গণতন্ত্রের উৎসব। প্রচার, উন্মাদনা থাকবেই। কিন্তু এখন যা ভাষা, মিথ্যে প্রতিশ্রুতির যে ফুলঝুরি, সারাক্ষণ চিৎকারের যা বহর, তাতে বিরক্ত লাগে।’’ পাশ থেকে মঞ্জুও বলছিলেন, ‘‘খবরের চ্যানেলে নেতাদের ঝগড়ায় যা হিংস্রতা!’’

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এই একই বিরক্তি বেলুড় মঠে ধ্যানে ডুবে থাকা প্রৌঢ় কিংবা অরবিন্দ আশ্রমে একটু শান্তির খোঁজে আসা বৃদ্ধার মুখের জ্যামিতিতে। এঁদের অনেকেই বলছিলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক দেশে ভোট তো হবেই। তা দিতেও যাই। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে এত হিংসা, একে-অপরকে এত নোংরা ভাষায় আক্রমণ, এত মিথ্যে, সারাক্ষণ এত চিৎকার ভাল লাগে না। মাইকের অত্যাচার তো পুজো-পার্বণেও থাকে। কিন্তু তেমনই ঘিরে থাকে একটা আনন্দের আবহ। এখন ভোটে তা কই?’’

রাস্তায় মিছিল। দরজায় প্রার্থী। কানের কাছে মাইক। খবরের কাগজ-টিভিতে সর্বক্ষণ একই আলোচনা আর উত্তেজিত চুলোচুলি। ভোট মরসুমে সব দিক থেকে সর্বক্ষণ ঘিরে ধরা এই আক্রমণও অনেকের কাছে আতঙ্কের। বিশেষত যাঁরা গুরুতর ভাবে অসুস্থ। কিংবা এমনিতেই পছন্দ করেন একটু নিরিবিলিতে নিজের মতো থাকতে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম বলছিলেন, ‘‘অনেকেই এমন নাগাড়ে আওয়াজে বিরক্ত হন। অথচ দিন দিন নৈঃশব্দের কোণা সমাজে কমে আসছে ক্রমশ। কমে যাচ্ছে ব্যক্তি পরিসর। এতে মানসিক চাপ বাড়ে। বাড়ে অস্থিরতা। আর যাঁরা এমনিতেই এ সব সমস্যায় ভোগেন, সারাক্ষণ ধেয়ে আসা কথা আর চিৎকারে তাঁরা আরও বিব্রত, বিপণ্ণ বোধ করেন।’’ অর্থাৎ, ভোট-পার্বণে কষ্ট বাড়ে তাঁদের।

ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এমন বহু রোগীকে রোজ দেখি, যাঁদের জীবন ঝুলছে অনিশ্চয়তার সরু সুতোয়। অনেকের প্রায় শিয়রে দাঁড়িয়ে মৃত্যু। এঁদের কথা একটু মাথায় রেখে, সহমর্মিতা বজায় রেখে ভোটের প্রচার সারা যায় না? কেউ বোঝার চেষ্টা করেন এঁদের মনের অবস্থা? এ কোন ভোট? এ কেমন প্রচার? এ কোন সমাজ?’’ দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত সুব্রত দত্ত বলছিলেন, ‘‘হাসপাতালের সামনে দিয়েও ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে যান যে প্রার্থী, দেশের ভাল ভাবতে গিয়ে তাঁর ঘুম উড়ে যাবে, সেই ভরসা হয় কি?’’

কনসালট্যান্ট হেমাটোলজিস্ট প্রান্তর চক্রবর্তীর মতে, ‘‘ভোট হোক। গণতন্ত্রে তা কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু একই সঙ্গে মাথায় রাখা হোক অসুস্থ মানুষগুলোর কথা। বিশেষত যাঁরা প্রায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।’’

হাসপাতালে ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে থাকা এক রোগী বলছিলেন, ‘‘সামান্য জ্বর-মাথাব্যথা হলেই মনে হয় অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকি। বিরক্তি লাগে সামান্য চিৎকারে। সেখানে যাঁদের রোগ গুরুতর কিংবা সেরে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় নেই, এত আওয়াজ আর চড়া পর্দার প্রচার তাঁদের ভাল লাগবে কী করে?’’

কঠিন রোগে আক্রান্ত তরুণী, অফিসফেরতা মাঝবয়স্ক, সদ্য কাজ হারানো যুবক, দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসা বৃদ্ধা, পাঁচ ঘরে কাজ করে সংসার চালানো ঠিকাকর্মী— এঁদের সঙ্গে দু’চারটে কথা বললেই একটি বিষয় স্পষ্ট। তা হল, প্রচারে আপত্তি নেই। কিন্তু মাইকের যথেচ্ছ ব্যবহার, অশালীন ভাষায় আক্রমণ, খবরের কাগজ-টিভিতে সর্বক্ষণ একই বিষয়ে নাগাড়ে আলোচনা— এই সমস্ত মিলিয়েই যেন দম বন্ধ হয়ে আসে অনেকের। বিশেষত যাঁদের জীবন-ইভিএমে পছন্দের বোতাম ‘একটু শান্তি’ চিহ্নে আঙুল দেওয়া আছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন