বরাক থেকে ব্রহ্মপুত্র

নাগরিকত্ব পরীক্ষার মাঝেই ভোটের উৎসব

দক্ষিণ অসমে বরাক উপত্যকার সঙ্গে বাকি অসম অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বিরাট পার্থক্য। সামাজিক। রাজনৈতিকও।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শিলচর শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:০৯
Share:

তারিখে তারিখে এ ভাবেই ফরেনার্স ট্রাইবুনালে হাজিরা দিতে আসেন ১০৩ বছরের চন্দ্রধর দাস। নিজস্ব চিত্র

বয়স বাহাত্তর, দেখে মনে হয় আরও বেশি। জীর্ণ চেহারা, আরও বেশি জীর্ণ পরনের কাপড়খানা। অক্ষরজ্ঞান নেই, পয়সাকড়ির কথা না বললেও চলে। পারকিনসন্স রোগে ভুগছেন ক্ষীরোদিনী দেবী। শিলচরের এনআরসি সহায়তা কেন্দ্রে এসেছেন কষ্ট করে, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি-তে নাম না-ওঠার নোটিসটি হাতে নিয়ে।

Advertisement

তাঁর পাশে বসে সুবলা দেবী, সঙ্গে তেরো বছরের মেয়েটি। সুবলার স্বামী অসুস্থ, তাই বাড়ি বাড়ি কাজ করে কন্যাকে তিনিই ইস্কুলে পড়াচ্ছেন। পড়াশোনা ভাল হচ্ছে না, এ বার সে নতুন ক্লাসে উঠতে পারেনি। মা-মেয়ে কারও নাম নেই এনআরসি-তে। শীর্ণ সন্ত্রস্ত মুখের মেয়েটির হাত ধরে তিনিও এসেছেন তাই।

অসমের বরাক জেলার প্রধান শহর শিলচরের এই কেন্দ্রটি সরকারি নয়— এনজিও-চালিত। সরকারি সেবা কেন্দ্রও আছে অবশ্য। কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগেও ‘সহায়তা’ লাগে বইকি। ক্ষীরোদিনী দেবীদের মতো এনআরসি-ছুটরা যখন আবার নাম ওঠানোর দরবার করতে যান, সঙ্গে কী কাগজপত্র নিয়ে যেতে হবে, সেই পরামর্শ বা সহায়তা দেওয়ার কাজটাই করে অ-সরকারি কেন্দ্রগুলো। তবে যা বুঝলাম, প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম মেলে এমন সহায়তা। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সেবা সংস্থা নামে এনজিও-টি এনআরসি পর্বের গোড়া থেকে এই কাজ করে আসছে। দুই ঘরের একটি বাড়িতে তাদের অফিস। দুপুরবেলাতেও ঘরভরা আঁধার, কারেন্ট থাকে না বললেই চলে। বেলা বাড়লে ব্যাটারির আলোর চার্জও শেষের মুখে এসে দাঁড়ায়। মোবাইলেরআলো জ্বেলেই অনলস ভাবে কাজ করে যান কর্মীরা।

Advertisement

শুধু কর্মীরা কেন? সুবলার কিশোরী কন্যা কেন মন দিয়ে পড়াশোনা করছে না, সে প্রশ্ন যদিও এনআরসি সহায়তার মধ্যে পড়ে না, তবু অভিভাবকসুলভ বকুনিটা যিনি দিলেন, তিনি কিন্তু সরকারি-অসরকারি কোনও রকম কর্মীই নন। ষাটোর্ধ্ব মানুষটি ব্যক্তিগত তাড়নাতেই রোজ এসে বসেন ওই সেন্টারে, কর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেন। উপায় কী? ক্ষীরোদিনী-সুবলাদের মতো অসহায় বিপন্ন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। খুঁজে পাওয়া কঠিন এমন নিবেদিতপ্রাণ সহায়কদেরও। রাষ্ট্র যখন মানুষের কথা ভাবে না, তখন মানুষই মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়।

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মুশকিল হল, বার বার বলে দিলেও কী কী কাগজপত্র নিতে হবে, ক্ষীরোদিনী দেবীরা ভাল করে বুঝে উঠতে পারছেন না। বোঝা কি সহজ? প্রথমে বলা হয়েছিল, এনআরসি-র জন্য লাগবে ‘লিগাসি-ডেটা’, বংশপরম্পরার হদিশ। অবাক কাণ্ড, নিরক্ষর মানুষেরা আর কিছু না বুঝলেও ‘লিগাসি’ কথাটা চট করে শিখে ফেলেছেন, ওটাই যে তাঁদের বাঁচার পথ। আইতাসি যাইতাসি-র কাছাকাছি বলেই বোধহয়, সিলেটি বাংলায় কথা বললেও লিখতে পড়তে না জানা মানুষও ‘লিগাসি’ বলে অপরিচিত শব্দটাকে শিখে নিয়েছেন। কিন্তু সে তথ্য দিয়েও যখন নাম ওঠেনি তালিকায়, বলা হল ‘ফ্যামিলি-ট্রি’ এঁকে আনতে। তার পর বলা হল ‘বায়োমেট্রিক’ পরীক্ষায় বসতে। একের পর এক, ধাপের পর ধাপ। এই সবের জন্য যদি বা ক্ষীরোদিনীকে তৈরি করা যায়, কে তাঁকে নিয়ে যাবে অত দূর!

— অনেক দূর? কোথায় সেবাকেন্দ্র?

সহায়তাকারীরা জানালেন, এই পর্যায়ে ‘ক্লেম’ বা দাবিপত্র জমা দিতে হচ্ছে বহু দূরে দূরে। কিন্তু ক্ষীরোদিনীকে তো নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই, আত্মীয়স্বজন কেউ না— কী হবে তবে? উত্তরহীনা ক্ষীরোদিনী। অসহায় সহায়তাকারীরা।

এই ভাবেই এক অবিশ্বাস্য সঙ্কটে ডুবে গিয়েছেন প্রতিবেশী রাজ্য অসমের লক্ষ লক্ষ মানুষ। কাকে বলে নাগরিকতা, কী করে প্রমাণ করতে হয় সেই বস্তু, কী হবে প্রমাণ না মিললে, পরিবার-পরিজন ছেড়ে ডিটেনশন সেন্টারে কোন্ অজানা ভয়াবহতায় গিয়ে পড়তে হবে, এই সমস্ত কিছু নিয়ে প্রশ্ন-অনিশ্চয়তা-গুজব-প্রচারের আবর্তে ঘুরে চলেছেন তাঁরা। আর এই সব কিছুর মধ্যেই, কী পরিহাস, এসে গিয়েছে নাগরিকত্বের সবচেয়ে বড় উৎসব— ভোট।

দক্ষিণ অসমে বরাক উপত্যকার সঙ্গে বাকি অসম অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বিরাট পার্থক্য। সামাজিক। রাজনৈতিকও। দেশভাগের সময় সাবেক শ্রীহট্ট বা সিলেট যখন গণভোটের মাধ্যমে চলে গেল পূর্ব পাকিস্তানে, বরাক উপত্যকাটি রয়ে গেল ভারতের অসমে। বাঙালি-অধ্যুষিত সেই উপত্যকায় হিন্দু-মুসলিম প্রায় সমান সমান। তবে বরাকের যে কাছাড় জেলাটি শ-খানেক বছর ধরে বাঙালি-প্রধান, সেখানে হিন্দু বাঙালি বেশি। অন্য দুটি জেলা করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দিতে মুসলিমরা সংখ্যায় বেশি, ষাট শতাংশের কাছাকাছি। কাছাড়ের প্রধান শহর শিলচরে পৌঁছে প্রথমেই দু’দিকে তাকিয়ে ধাঁধা লেগে যায় তাই— এই নাকি অসম? বাংলা ছাড়া কোনও সাইনবোর্ড আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও মেলে না! রামকৃষ্ণ ভোজনালয়ের পাশে ‘ভোডাফোন মিনি’ কথাটাও বাংলা অক্ষরে লেখা। বিশাল সবুজ গাঁধীবাগ উদ্যানের পাশেই গাঁধী শান্তি আশ্রম। বোরখা-পরিহিত মহিলাদের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল মোড়ে আবক্ষ মূর্তি। কার? শহিদ ক্ষুদিরাম। দেখতে দেখতে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, হিন্দু-মুসলমান মেশানো বাঙালি এই সমাজের বিরুদ্ধে অসমিয়াদের ক্ষোভটা কোথায়, আর সেই ১৯৭৯ থেকে ‘বঙ্গাল খেদাও’ প্রতিহত করে কী ভাবেই বা এত দিন নিজের চরিত্র সগর্বে বজায় রাখলেন এঁরা? উদ্বাস্তু-বিরোধী এই ধিকিধিকি রাগের মধ্যেই কি তবে লুকিয়ে এনআরসি
সঙ্কটের উৎস?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন