general-election-2019-journalist

‘দদ্দা’কে জিতিয়ে দিন, মইনপুরী যেন মালদহ

উত্তরপ্রদেশের ভোট বরাবর জাতপাতের জটিল সমীকরণ। তা মাথায় রেখেই এ জেলায় এসপি-র জেনারেল সেক্রেটারি সুখবীর সিংহ যাদব বলছেন, ‘‘এই আসনের ৪ লক্ষ যাদব আর ৬০ হাজার মুসলিম ভোট পকেটে নিয়েই লড়তে নামেন নেতাজি।”

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

মইনপুরী শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৪৪
Share:

সৈফইয়ের বাড়িতে মুলায়মের ভাই অভয়রাম যাদব। নিজস্ব চিত্র

জড়িয়ে যাচ্ছে কথা। বয়সের ভারে মাঝেমধ্যেই বিশ্বাসঘাতকতা করছে স্মৃতি। দলের উপরে নিয়ন্ত্রণও অনেকটা সরে গিয়েছে ছেলে অখিলেশ যাদবের হাতে। তবু এই ৭৯ বছর বয়সে মইনপুরীর ভোট-আখড়ায় তিনিই পালোয়ান। মুলায়ম সিংহ যাদব। এ তল্লাটের ‘নেতাজি’।

Advertisement

লখনউ থেকে ২৫৬ কিলোমিটার দূরে উত্তরপ্রদেশের এই জেলায় লোকসভা ভোটে কখনও দাঁত ফোটাতে পারেনি বিজেপি। সেই ১৯৯৬ থেকে এই আসন মুলায়মের সমাজবাদী পার্টির (এসপি) দুর্গ। গত বার প্রবল মোদীঝড়েও এখান থেকে ৩ লক্ষ ৬৪ হাজার ভোটে জিতেছিলেন তিনি। পরে নিজের অন্য আসন আজমগড় ধরে রেখে মইনপুরী থেকে জিতিয়ে এনেছিলেন দাদা রতন সিংহ যাদবের ছেলে তেজ প্রতাপ সিংহ যাদবকে। ৩ লক্ষ ২১ হাজার ভোটে।

উত্তরপ্রদেশের ভোট বরাবর জাতপাতের জটিল সমীকরণ। তা মাথায় রেখেই এ জেলায় এসপি-র জেনারেল সেক্রেটারি সুখবীর সিংহ যাদব বলছেন, ‘‘এই আসনের ৪ লক্ষ যাদব আর ৬০ হাজার মুসলিম ভোট পকেটে নিয়েই লড়তে নামেন নেতাজি। তার বাইরেও শাক্য, ক্ষত্রিয়, লোধী-রাজপুত, বৈশ্য, দলিত এমনকি, ব্রাহ্মণদের একটা বড় অংশ মুলায়মের ভোটার। কারণ, এই এলাকার জন্য তাঁর কাজ। তার উপরে এ বার বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) সঙ্গে গাঁটছড়া। তাই অন্তত ৫ লক্ষ ভোটে জয় নিশ্চিত।’’ মুলায়মের বিপুল জয়ের পূর্বাভাস দিচ্ছেন জেলায় বসপার নেতা শুভম সিংহও। আর বিজেপির জেলা অধ্যক্ষ অলোক গুপ্ত বলছেন, ‘‘লিড তো আসে দু’টি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। কড়েল ও যশবন্তনগর। যেখানে অবাধ ছাপ্পা, ১৫০% ভোট পড়ার অভিযোগও উঠেছে আগে।’’ এ বার মইনপুরীতে ইন্দ্রপতনের জন্য তাই মোদী ও যোগী সরকারের কড়া নজরদারিতে হওয়া ভোটের উপরে আস্থা রাখছেন তাঁরা।

Advertisement

কে জিতবেন, তা নিয়ে এলাকার মানুষের সংশয় তেমন চোখে পড়ল না। কিন্তু আলোচনার পুকুরে ঢিল ফেলেছেন মুলায়ম নিজে। দীর্ঘদিনের ‘শত্রু’ আর এ বারের ভোটে তাঁর দলের ‘বন্ধু’ মায়াবতীর সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, এই তাঁর শেষ ভোটে দাঁড়ানো। শরীরের কারণে প্রচার তেমন করেননি। শুধু বলেছেন, অতীত মনে রেখে যেন ‘দদ্দা’কে (বড় ভাই) জিতিয়ে দেয় মইনপুরী।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ব্যস, ওইটুকু। তাতেই যেন পাঁচ দশক পিছিয়ে গিয়েছে মইনপুরী। দেবেন্দ্র সিংহ, উদ্দেশ যাদব, যশ চৌধুরী, সবিতা যাদবের মতো স্থানীয়রা বলছিলেন, ‘‘নেতাজির জন্যই তো এই এলাকাকে সারা দেশ চেনে। এখানকার জন্য কী করেননি তিনি? রাস্তা, মেডিক্যাল কলেজ, স্কুল, হাসপাতাল।’’

বিরোধী মতও আছে। অনেকেই ভুলতে পারেন না তাঁর জমানায় কী ভাবে ‘মার খেতে হয়েছে’ যাদব ও মুসলিম ছাড়া অন্যদের। উঠে এল পরিবারে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি, দুর্নীতির অভিযোগও। কিন্তু নেতাজি আর ভোটে না লড়লে, মইনপুরীতে শূন্যতা যে তৈরি হবে, তা মানছেন তাঁরাও। সুরেশ রানা বলছিলেন, ‘‘রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকলেও তা পাশে সরিয়ে রেখে সব সময় সবার কথা শুনতেন নেতাজি। কেউ কখনও তাঁর পাশে দাঁড়ালে, আজীবন তা মনে রেখেছেন।’’

লখনউ থেকে আগরা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আসার সময়ে মইনপুরী শহরের ৩৫ কিলোমিটার আগেই সৈফই। মুলায়মের জন্ম এখানেই। একের পর এক স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, স্টেডিয়াম, এমনকি চার্টার্ড প্লেন নামার বিমানবন্দরও! অথচ পরীক্ষায় অবাধ টোকাটুকি, শিক্ষা মাফিয়ার দাপটের অভিযোগ উত্তরপ্রদেশে সব থেকে বেশি উঠেছে মুলায়মের জমানাতেই। কিন্তু তাতে থোড়াই কেয়ার সৈফইয়ে জোর চর্চা মুলায়মের ভোট-রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া আর যদু বংশের মুষল পর্ব নিয়ে। যে ভাবে ছেলে অখিলেশ আর ছোট ভাই শিবপাল সিংহ যাদবের মধ্যে লড়াই চলছে, তাতে মুলায়ম কষ্ট পাচ্ছেন বলেই ধারণা আমজনতার।

তিন-তিন বার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া, কেন্দ্রে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়া এখানে লোকের মুখে মুখে ফেরে। সাধারণ ঘর আর পিছিয়ে পড়া ‘জাত’ থেকে উঠে এসে মুলায়ম যে আট বারের বিধায়ক আর কত বারের সাংসদ তা লোকের ঠোঁটস্থ। কুস্তির আখড়ায় পালোয়ান মুলায়মকে পছন্দ হয়ে যাওয়ায় কী ভাবে তাঁকে নিজের জেতা আসন নাথু সিংহ ছেড়ে দিয়েছিলেন, তা বলতেই স্মৃতিতে ডুব দিচ্ছেন বয়স্ক মানুষেরা। রেগে যাচ্ছেন করসেবকদের উপরে গুলি চালানো কিংবা মুলায়মকে বিরোধীরা ‘মোল্লা’ তকমা দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলেও। ১৯৯৬ সালে লালুপ্রসাদ যাদব মুলায়মের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনায় জল ঢেলে দেওয়া নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে এলাকায়। নেতাজির ‘বিতর্কিত’ দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলে পাল্টা প্রশ্ন আসে, ‘‘প্রথম স্ত্রী থাকাকালীন দ্বিতীয় নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালেও, পরে তো তাঁকে স্ত্রীয়ের মর্যাদা দিয়েছেন। তা হলে?’’

সৈফইয়ে মুলায়ম, অখিলেশের বাড়ির পাশেই তাকিয়ায় বসে অভয়রাম যাদব। বাড়ির দরজা হাট করে খোলা। অজস্র মানুষের আনাগোনা আর অবিরত ‘‘নমস্কার জি, রাম রাম।’’ পিছনে এক পাল গরু, মোষ, খান কয়েক ঘোড়াও। জিজ্ঞাসা করলাম, দেখে তো মনেই হয় না যে, আপনি মুলায়মজির ভাই! খেটো ধুতির কোঁচা ঠিক করতে করতে জবাব দিলেন, ‘‘এটাই তো ভোটে জেতার চাবিকাঠি। এই বছরভর লোকের গা ঘেঁষে থাকা, একই রকম ব্যবহার—এটাই আমাদের পরিবারের সংস্কৃতি। নেতাজি, অখিলেশ কেউ ব্যতিক্রম নন।’’ তাঁর মতে, ‘‘লোকে নেতাজির সাফল্যটুকুই মনে রেখেছে। কিন্তু তার পিছনে যে অকল্পনীয় পরিশ্রম আছে, জানেন না অনেকে। এক সময়ে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। প্রচারে সম্বল সাইকেল, বড়জোর অন্যের বাইকের সিট। এখন নেতাজি চলে গেলে, মন খারাপ তো হবেই।’’

মন যে খারাপ, তা টের পাওয়া যাচ্ছে তল্লাটে ঢুঁ মারলেই। এ সবেরই মধ্যে রোশন যাদবদের মতো কয়েক জন শুধু বললেন, ‘‘কুস্তিগির তো, জানেন আখড়া ছাড়ার এটাই ঠিক সময়। শরীর দিচ্ছে না। উত্তরাধিকারী বাছাই শেষ। চোখের সামনে দেখতে হচ্ছে কাকা-ভাইপোর লাঠালাঠি। মাঝেমধ্যে বেফাঁস কথা বলে ফেলছেন নিজেই। হয়তো সব মিলিয়েই ভোট-রাজনীতি ছাড়ার সিদ্ধান্ত।’’

মালদহে শেষ বার লড়ার আগে ‘বুড়া’কে জেতানোর কথা বলেছিলেন আবু বরকত আতাউর গনি
খান চৌধুরী। মইনপুরীর এখন মালদহের দশা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন