দূষণ-কবলিত মণিকর্ণিকার ঘাট। নিজস্ব চিত্র
‘আচমন করনে কি লায়েক নেহি হ্যায় ইহা কা পানি।’
বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি-র প্রশাসনিক ভবনে নিজের ঘরে বসে বেশ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলো বলছিলেন প্রদীপ কুমার মিশ্র। বাইরে চড়া রোদ। কিন্তু নিরিবিলি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরটিতে বসে তা বোঝার উপায় নেই। তাপ যেটুকু গায়ে লাগল, তা ওই বারাণসীর গঙ্গা, ‘আচমন’ প্রসঙ্গে। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান প্রদীপবাবু দীর্ঘ কয়েক বছর গঙ্গার দূষণ নিয়ে গবেষণা করেছেন। বলছিলেন, ‘‘গঙ্গা-দূষণ রোধে কেন্দ্রীয় সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন যদি সাহায্য না করে তা হলে কী করে হবে!’’
গঙ্গা-দূষণ!— লোকসভা নির্বাচনের আগে বারাণসীর গঙ্গার জল এখন টগবগ করে ফুটছে! স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর লোকসভা কেন্দ্রে গঙ্গা দূষণ নিয়ন্ত্রণে এনডিএ সরকারের একাধিক ঘোষণা, নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের ‘নমামি গঙ্গে’র প্রকল্পের রূপায়ণ কতটা হল, তার আলোচনা, বিতর্ক-বিবাদ রাস্তায় কান পাতলেই শোনা যাবে, এটা বোধহয় স্বাভাবিকই। তবে গঙ্গার স্রোতে নতুন আলোড়ন তৈরি হয়েছে কয়েক দিন আগে প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরার সফরের কারণে। অস্সী ঘাটে অল্পবয়সি যে ছেলেটি রোজ চা বিক্রি করে, সে-ও উচ্ছ্বসিত প্রিয়ঙ্কাকে দেখে। বছর পনেরো চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে বলছে, ‘‘প্রিয়ঙ্কা ম্যাডামকে দেখেছি সেদিন!’’ ফলে বারাণসীর গঙ্গা এই মুহূর্তে আরও বেশি ‘রাজনৈতিক’!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আইআইটি, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক তথা গঙ্গা-দূষণ নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান বিশ্বম্ভরনাথ মিশ্র বলেন, ‘‘নিজের চোখে দেখলেই বোঝা যাবে যে বারাণসীর গঙ্গার কী অবস্থা!’’ বিশ্বম্ভরবাবু প্রয়াত বীরভদ্র মিশ্রের ছেলে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শিক্ষক বীরভদ্র ছিলেন বারাণসীর গঙ্গা-দূষণ রোধ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ। তিনিই প্রশ্ন তুলেছিলেন, রাজীব গাঁধীর গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের সার্থকতা নিয়ে। এখন যেমন প্রশ্ন উঠছে নমামি গঙ্গে নিয়ে!
এমনিতে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহরের সংস্কৃতি, রাজনীতি, নিত্যদিনের সঙ্গে গঙ্গা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এক সময় এই বারাণসীতেই গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের (গ্যাপ) ঘোষণা করেছিলেন রাজীব, যেমন পরবর্তীকালে নরেন্দ্র মোদী এখান থেকেই ঘোষণা করেছেন স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের। কিন্তু গঙ্গার দূষণ তাতে কমেছে কি? বারাণসীর বাসিন্দাদের একাংশই বলছেন, নাহ! কমেনি!
ছোট্ট গলি। কলকাতায় এমন গলিতে পাশাপাশি দু’টো মানুষও যাতায়াত করতে পারবেন কি না সন্দেহ, অথচ তার মধ্যে দিয়েই এ শহরে কী অদ্ভুত দক্ষতায় ষাঁড়-গরু-মানুষ, এমনকি, মোটরবাইকও অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। গলিটা যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে পরপর কাঠের আড়ত। আড়তগুলো এড়িয়ে গঙ্গার পাড়ে গেলেই চোখে পড়বে সারবদ্ধ চিতা। মণিকর্ণিকা ঘাটের সগৌরব জনশ্রুতি হল, এখানকার চিতার আগুন কখনও নেভে না। একের পর এক চিতায় শবদাহ হচ্ছে। ফুল ডাঁই করে রাখা রয়েছে পাড়ে। আধপোড়া কাঠ ভেসে যাচ্ছে গঙ্গার স্রোতে। চিতার আগুন, পোড়া গন্ধ, অবিরল রামনাম, সব মিলিয়ে আলাদা পরিবেশ। কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর উপায় নেই। বাতাসে উড়ে আসা ছাইয়ে জামা-কাপড়ের রং পাল্টে যেতে বাধ্য।
মণিকর্ণিকা-সহ অন্য ঘাটে যে ভাবে শবদাহ হয়, তার ফলে গঙ্গা কী ভাবে দূষিত হচ্ছে, তার বিস্তারিত সমীক্ষা করা হয়েছিল অতীতে। দেখা গিয়েছিল, ‘বারাণসী শহরে প্রতি বছর তিন হাজার আধপোড়া মরদেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এর ৬০ শতাংশই আসে মণিকর্ণিকা ঘাট থেকে, বাকি ৪০ শতাংশ অন্য পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে।’ ২৫-৩০ বছর আগে করা সেই সমীক্ষা থেকে বর্তমানে খুব একটা পার্থক্য হয়েছে বলে মনে হল না!
‘‘আসলে এটা এখানকার পরম্পরা,’’ বলছিলেন গোপাল পাণ্ডে। তুলসীদাস ঘাটে গঙ্গার জল পরীক্ষার কেন্দ্র রয়েছে। গোপালবাবু সেই কেন্দ্রেরই এক কর্মী। ওই কেন্দ্রে রোজ গঙ্গার জলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু প্রতিবার তাতে ন্যূনতম পাশ-মার্ক তুলতেও ব্যর্থ গঙ্গার ‘পবিত্র’ জল! গোপালবাবু বলছিলেন, ‘‘কলিফর্ম, বিওডি তো পরিসংখ্যান মাত্র। আসল কথা হল, ঘাটের ৫০-২০০ মিটারের মধ্যে গঙ্গার জল খাওয়া দূরের কথা, স্নানযোগ্যও নয়!’’
অথচ পুরো শহরটাই উপচে পড়েছে একের পর এক ঘাটে। অসসি ঘাট ধরে যাত্রা শুরু করে অনায়াসে তিন-চার কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যায়। ঘাট সংলগ্ন ঐতিহাসিক, পুরনো স্থাপত্য। শহরের ৮৪টির মতো ঘাটে পঞ্চাশ-ষাট হাজার লোক গঙ্গায় অবগাহন করেন রোজ। দূষণের তোয়াক্কা না করেই! ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক আনন্দ কুমার সিনহা বলছিলেন, ‘‘বিজেপি সরকার যদিও বলছে যে, আগামী দু’বছরে গঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে, ব্যাপারটা এতটা সহজ নয় মোটেই!’’
সহজ যে নয় শহরটা ঘুরলেই তা টের পাওয়া যায়। রাস্তায় যেমন যান নিয়ন্ত্রণের বালাই নেই, তেমন নিকাশি-নালাগুলিও ‘আপন বেগে পাগলপারা’ হয়ে গঙ্গায় মিশছে। গঙ্গার জল ৮০ শতাংশ সাফ হয়েছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এমন দাবির পরেও! যেমন রবি দাস ঘাটেই বারাণসীর অন্যতম বড় নিকাশি নালা সবেগে গিয়ে গঙ্গায় মিশছে। নালার জলের শব্দ দূর থেকে শুনলে প্রথমে মনে হয় যেন ঝর্নার জলের আওয়াজ! কিন্তু কিছুটা এগোলেই আবর্জনাযুক্ত কালো জলের কটু গন্ধ। ঘাটের পাশেই পাম্পিং স্টেশন। কিন্তু তাতে সারাক্ষণই তালা বন্ধ, আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুয়োর, গরু!
বারাণসীর প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক অজয় রাইয়ের অভিযোগ, ‘‘নমামি গঙ্গের নামে বারাণসীতে প্রচার চলছে। অবশ্য মোদী প্রচার ছাড়া আর কী-ই বা করেন! তবে আগে যত নালা গঙ্গায় পড়ত, এখনও তাই পড়ে।’’ স্বাভাবিক ভাবেই যে দাবি উড়িয়ে দিয়ে বারাণসীর বর্তমান বিজেপি বিধায়ক সৌরভ শ্রীবাস্তবের দাবি, ‘‘নরেন্দ্র মোদীর নাম ঘোষণার পরে অন্য রাজনৈতিক দলগুলি আর প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না, তাই এসব উল্টোপাল্টা বলছে। না হলে যাঁরা আগে বারাণসীতে এসেছেন, তাঁরা এখন এখানে এসে বলছেন, এখানকার গঙ্গা পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে। দূষণ গিয়েছে কমে!’’
তুলসীঘাটে বসা বুড়ো পুরোহিত অবশ্য বললেন, ‘‘ওসব নমামি গঙ্গে ছাড়ুন তো। আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে রামচরিতমানসের গুরুত্ব কতটা সেটা বুঝতে পারছেন তো!’’ তার আগেই তিনি দেখিয়েছেন, এখানে কোথায় বসে তুলসীদাস ‘রামচরিতমানস’ লেখা শেষ করেছিলেন। কথাটা শেষ করে অর্থবহ হাসিও হাসলেন।
হয়তো ঠিকই! এখানকার চালু রসিকতাই হল, নমামি গঙ্গের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তুলুন। প্রশ্ন তুলুন রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর লোকসভা কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ‘রামনাম’ নিয়ে সংশয়?
সারা দেশে ৫৬ ইঞ্চি বুকের পাটা আর কারও আছে না কি!