মৃত্যু ঘিরে খেয়োখেয়ি, ভোট-বাজারে ‘জীবিত’ আম্মা

জয়ারাম জয়ললিতার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল কি না, সেই বিতর্ক তামিলনাড়ুর ভোটের রাজনীতিকে উস্কে দিচ্ছে এখনও।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায় 

চেন্নাই শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৯ ০৩:৫৫
Share:

প্রাসাদোপম: চেন্নাইয়ের ‘পোয়েজ গার্ডেন’-এ জয়ললিতার বাড়ি। তালাবন্ধ, তবু উৎসাহের কেন্দ্রে। —নিজস্ব চিত্র।

চেন্নাইয়ের নিরিবিলি ‘পোয়েজ গার্ডেন’-এর প্রাসাদোপম বাড়ি এখন নিঝুমপুরী। তালাবন্ধ। কেউ থাকেন না। বাইরে পুলিশের কড়া পাহারা। ভিতরে যাওয়া তো দূরঅস্ত্, সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাও নিষেধ। ভক্তেরা দূর থেকেই সে বাড়ি দেখে যান। কেউ আবার চেন্নাই ঘুরতে এসে বাড়ির দিকে চেয়ে প্রণামও ঠোকেন। ২০১৬-র ডিসেম্বরে তিনি চলে গেছেন। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ‘জীবিত’ হয়ে উঠেছেন ‘আম্মা’।

Advertisement

জয়ারাম জয়ললিতার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল কি না, সেই বিতর্ক তামিলনাড়ুর ভোটের রাজনীতিকে উস্কে দিচ্ছে এখনও। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মৃত্যুর কারণ শুধুই শারীরিক অসুস্থতা, না কি অন্য কোনও ষড়যন্ত্র ছিল তার পিছনে— সে নিয়ে বিতর্ক চলছে ২০১৬ র ডিসেম্বর থেকেই। কিন্তু ভোটের বাজারে সেই বিতর্ককে মূলধন করে এডিএমকের ঘরোয়া কোন্দলে আরও ইন্ধন জোগাচ্ছে ডিএমকে।

প্রায় প্রত্যেক জনসভায় গিয়ে ডিএমকে প্রধান এম কে স্ট্যালিন জয়ললিতার মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলছেন। বলছেন, ‘‘কেন্দ্র ও রাজ্য দু’পক্ষই উদাসীন। আমরা ক্ষমতায় এলে আম্মার মৃত্যুর যথাযথ তদন্ত হবে।’’ তাঁর প্রশ্ন, হাসপাতালে থাকাকালীন জয়ললিতার দৈনন্দিন স্বাস্থ্যের খবর কেন যথাযথ ভাবে জানতে পারতেন না সাধারণ মানুষ? কেন তাঁকে হাসপাতালে দেখার সুযোগটুকুও পেতেন না কেউ? কেন জয়ললিতার ছবি-ভিডিও প্রকাশে বাধা ছিল? হাসপাতালে থাকাকালীন যে সব জরুরি নথিতে জয়ললিতার আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয়, সেগুলি আদৌ তাঁর কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বারবার। স্ট্যালিনের কথায়, ‘‘কমিশন গড়ে তদন্ত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার কাজ এত ঢিমেতালে যে মানুষ ভরসা রাখতে পারছেন না। যে দল নিজেদের সর্বময় কত্রীকে সুরক্ষা দিতে পারে না, তারা রাজ্যের মানুষকে সুরক্ষা দেবে কী ভাবে?’’

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মাদুরাইয়ের এক জনসভায় স্ট্যালিন এ কথা বলার পরে যখন জনতার হাততালি থামতেই চায় না, তখন সভাস্থলের একেবারে পিছনে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন এক বৃদ্ধ। জানা গিয়েছিল, এডিএমকের কট্টর সমর্থক ওই বৃদ্ধ জয়ললিতার মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই দল থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। চোখেমুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর পরে বৃদ্ধের একটাই কথা, ‘‘আমিও তো এটাই বলতে চেয়েছি। আমি তো জানি, আম্মা এ ভাবে মারা যেতে পারেন না। ওরা আম্মাকে বাঁচতে দিল না।’’

শুক্রবার চেন্নাইয়ের সদর দফতরে বসে ডিএমকের মুখপাত্র এলানগোভান বললেন, ‘‘আমাদের কিছুই করতে হচ্ছে না। ওরা নিজেরাই খেয়োখেয়ি করে মরছে। খেয়াল করুন, মৃত্যু নিয়ে বিরোধীরা কিন্তু গোড়ায় কিছু বলেনি। উনি অসুস্থ ছিলেন। চিকিৎসায় সাড়া দেননি। মারা গিয়েছেন। এটা হতেই পারে। কিন্তু মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করার কোনও চেষ্টা হয়েছিল কি না সেটাই সব চেয়ে বড় প্রশ্ন। সেটা নিয়ে ওরাই পরস্পরকে সন্দেহ করছে। আমরা শুধু সেই সন্দেহটাকেই সামনে আনছি, এই যা।’’

প্রসঙ্গত, জয়ললিতার মৃত্যু নিয়ে এডিএমকে নেতা সি শ্রীনিবাসনের সঙ্গে এডিএমকে থেকে বিতাড়িত অধুনা আম্মা মাক্কাল মুন্নেত্র কাজাখম নেতা, শশিকলার ভাগ্নে টি টি ভি দীনাকরণের বিবাদ ‘কলতলার ঝগড়া’য় পৌঁছেছে। শ্রীনিবাসন ক্রমাগত দাবি করে চলেছেন, তাঁকে আম্মার স্বাস্থ্য নিয়ে মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য করতেন জয়ললিতার প্রাণের বান্ধবী শশিকলা। আর দীনাকরণের পাল্টা দাবি, সবটাই মিথ্যা কথা। আখের গোছাতে চাইছেন শ্রীনিবাসনের মতো নেতারা।

শুধু মৃত্যুর কারণ ঘিরে নয়, আম্মাকে নিয়ে এখন সবেতেই দলাদলি আর ভাগাভাগি। এডিএমকে-র সদর দফতরে কথা বলতে গিয়েও সেটা টের পাওয়া গেল। মুখ্যমন্ত্রী ই পালানিস্বামী এবং উপমুখ্যমন্ত্রী পনিরসেলভমের গোষ্ঠী তো আছেই, পাশাপাশি ছোট, ছোট স্তরে আছে অনেক আমরা-ওরার গল্প।

এডিএমকের মুখপাত্র ভৈগাহীসেলভন অবশ্য বলেছেন, ‘‘কোথাও কোনও সন্দেহ নেই। যাদের দলে থাকার যোগ্যতা নেই তাদের বিদায় করা হয়েছে। যাঁরা দলে আছেন, তাঁদের মধ্যে কোনও সংশয় নেই।’’

তা হলে শশিকলাপন্থী পালানিস্বামী এবং জয়ললিতার অনুগত পনিরসেলভমের বিবাদ কি পুরোটাই অপপ্রচার? প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। যাবে না সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক।

তবে দল থেকে তাড়ানোর পরেও গরাদের আড়ালে শশিকলা যে নিজের মতো করে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, সে কথা এডিএমকে নেতাদের অনেকেই স্বীকার করেছেন। জানিয়েছেন, শশিকলার কাছে নিয়মিত সব খবরই পৌঁছয়। দলের একটি গোষ্ঠীর রণকৌশল এখনও তিনিই ঠিক করেন। এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, ‘‘এই মহিলাকে বিশ্বাস করেই সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলেন আম্মা। নিজের জীবন দিয়ে তার মাসুল গুনতে হল।"

চেন্নাইয়ের ট্যাক্সিচালক মৈত্রেয়ন বললেন, ‘‘আম্মা এ ভাবে মারা যেতে পারেন না। স্লো পয়জন করা হয়েছিল।’’ গলা শুনেই বোঝা গেল, গভীর বিশ্বাস থেকেই কথাগুলো বলছিলেন তিনি। আবার এগমোরের ফলের ব্যবসায়ী মুন্নুস্বামীর বক্তব্য, ‘‘চিন্নাম্মাকে (শশিকলা) সন্দেহ করে আম্মাকে ছোট করা হচ্ছে। চিন্নাম্মা জেল থেকে ফিরলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’’

গাড়িতে জয়ললিতার ছবি। নেতাদের শার্টের পকেটেও জয়ললিতার ছবি। কিন্তু সেই ছবির পিছনে অনেকগুলো মুখ পরস্পরকে ঠেলে সরিয়ে নিজের জায়গা করার চেষ্টা করছে। দলের প্রবীণ নেতারা স্বীকার করেছেন, ডিএমকে নয়, কংগ্রেসও নয়। এই খেয়োখেয়িই তাঁদের প্রধান প্রতিপক্ষ।

পোয়েজ গার্ডেনের সামনে পাহারায় থাকা তরুণী পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘এক সময়ে যাবতীয় ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল এই বাড়ি। আজ বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে কেমন যেন গা ছমছম করে।’’

উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে আম্মা এখন ভাগের মা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন